সিরাজগঞ্জে ২ কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদনের সম্ভাবনা
অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
টিনের বড় পাত্রে জ্বাল দিয়ে খেজুরের গুড় তৈরি করছেন গাছিরা
বাণিজ্যিকভাবে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় খেজুর রস সংগ্রহ ও সুস্বাদু গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন পেশাদার ও মৌসুমী গাছিরা। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে এই গুড় চলে যাচ্ছে বিভিন্ন জেলায়। চলতি মৌসুমে জেলায় ২ কোটি ৩০ লাখ টাকার খেজুর গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করেছে কৃষি অফিস।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের তথ্য মতে, সদর উপজেলায় ৪০, রায়গঞ্জে ৮০০, তাড়াশে ১ হাজার ৬২৬, উল্লাপাড়ায় ১ হাজার ৪৩৩, শাহজাদপুরে ২০০, বেলকুচিতে ৯৫ ও চৌহালীতে ৫৬টিসহ মোট ৪ হাজার ২৫০টি খেজুরের গাছ রয়েছে। এবছর ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৫০ কেজি খেজুর গুড়ের বাজার মূল্য প্রায় ২ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। শীতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৭৫ দিনে জেলায় ২০০-৩০০ জন মানুষ খেজুরের রস সংগ্রহ, গাছের পরিচর্যা ও গুড় তৈরি কাজে যুক্ত থাকবেন।
রোববার (১৭ ডিসেম্বর) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরবঙ্গের শস্য ও মৎস্য ভান্ডারখ্যাত সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ ও উল্লাপাড়ায় খেজুর গাছের সংখ্য বেশি। শীত মৌসুমের শুরুতেই রাজশাহী ও নাটোরের বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা গাছিরা মালিকদের কাছ থেকে খেজুর গাছ লিজ নেন। শুরুর প্রথমদিকে প্রতিদিন পাটালি গুড় তৈরি হয়। এই গুড় বিক্রি হয় ২০০ টাকা কেজি দরে। শীতের মাঝামাঝি থেকে প্রতিদিন পাটালির পাশাপাশি তৈরি হয় ঝোলা গুড়। প্রতি কেজি ঝোলাগুড় বাজারে পাইকারদের কাছে ১৯০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি করেন গুড় উৎপাদনকারীরা।
নাটোর থেকে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরি করতে আসা আলতাব শেখ, করিম উদ্দিন, সাইফুল ও জুলমাত শেখ জানান, তাদের কেউ ২৫ বছর, আবার কেউ ২০ বছর ধরে গুড় তৈরি ও খেজুর রস সংগ্রেহের কাজ করছেন। প্রতিদিন বিকেলে খেজুর গাছের সাদা অংশ পরিষ্কার করে ছোট-বড় মাটির হাড়ি বেঁধে রাখা হয়। মাটির পাত্রের ভেতর রস পড়ার জন্য বাঁশের তৈরি নালার মতো একটি খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয় গাছের সঙ্গে। এভাবেই সারা রাত গাছ থেকে খেজুর রস মাটির পাত্রে জমা হয়। পরদিন ভোরে গাছ থেকে রস নিয়ে টিনের বড় পাত্রে জ্বাল দিয়ে পাটালি, ঢিমা ও লালি গুড় তৈরি করা হয়।
রাজশাহী থেকে আসা জালাল উদ্দিন জানান, এবছর ৩৫০টি গাছ লিজ নেওয়া হয়েছে। প্রস্তুত করা প্রতিটি গাছ থেকে সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন রস সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি গাছ থেকে শুরুতে এক থেকে দুই কেজি করে রস সংগ্রহ হয়। আস্তে আস্তে রস সংগ্রহের পরিমাণ বাড়ে। প্রতিদিন ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ গাছের রস সংগ্রহ করা হয়। এক মণ রস চুলায় জ্বাল করার পরে বিক্রি উপযোগী ৫ কেজি পাটালি, ৭ কেজি দানা গুড় ও ৮ কেজি ঝোলাগুড় পাওয়া যায়।
গাছিরা জানান, গ্রামের ঘরে ঘরে খেজুর রসের পিঠা, পায়েস, গুড়ের মুড়ি-মুড়কি ও নানা ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরির ধুম পড়ে শীতকালে। বাজারে খেজুরের গুড়ের চাহিদা এসময় প্রচুর বৃদ্ধি পাই। বিভিন্ন স্থানের পাইকাররা এসে গুড় প্রস্তুতকারীদের কাছ থেকে গুড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা কুড়ান শেখ, মফিজ উদ্দিন, শাহেব আলী, সাগর হোসেন জানান, গ্রাম বাংলার প্রাচীন এক ঐতিহ্য খেজুরের গুড়। শীতের ভোরে গ্রামীণ জনপদে খেজুরের রস সংগ্রহে বের হন গাছি ও কৃষকরা। কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উঁকি দেওয়ার আগেই গ্রামের বাড়ি ও বিভিন্ন স্থানে মাটির চুলায় সেই রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজ শুরু হয়। রস থেকে নানা ধরণের পাটালি এবং ঝোলা গুড় উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে, খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য রক্ষায় চিনি ও হাইডোজ ব্যবহার বন্ধের জন্য প্রশাসনের নজর দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
তাড়াশের ধামাইনগর গ্রামে ঢাকা থেকে পাইকারি গুড় কিনতে আসা ফজলার রহমান বলেন, খাঁটি খেজুরের গুড় পাইকারি প্রকার ভেদে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি। তবে ভালো মানের গুড়ের দাম ২০০ টাকা কেজি। চাহিদা বেশি ভালো মানের গুড়ের। ১০ মণ গুড় কিনলাম। অর্ডার দিয়েছি আরও ৩০ মণের।
সিরাজগঞ্জ বড় বাজারের গুড় ব্যবসায়ী আনিছুর রহমান জানান, খাঁটি খেজুরের পাটালি খুচরা ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি ও ঝোলা গুড় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে, কিছু গুড় রয়েছে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি। শীত মৌসুমে খেজুর রসের পিঠা, পায়েস, গুড়ের মুড়ি-মুড়কি জন্য ভালো মানের গুড় নিচ্ছেন অনেকেই। বাজারে ভালো মানের খেজুরের গুড়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি।
সিরাজগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. রাম পদ রায় বলেন, বাদুড় থেকে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়। খেজুরের রসে ও রস থেকে মানুষের শরীরে এ ভাইরাস এসেছে। তাই খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যদি কেউ খেজুরের কাঁচা রস খেতে চান তাহলে রস সংগ্রহের পর আগুনে ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে জ্বাল দিলেই ভাইরাস মরে যাবে। আমি মানুষকে সচেতনতার জন্য কাঁচা খেজুর রস খাওয়া থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করছি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (উপ-পরিচালক) বাবলু কুমার সূত্রধর বলেন, জেলার বিভিন্ন উপজেলার মেঠো পথ ও বাড়ির আঙ্গিনায় পর্যাপ্ত খেজুর গাছ ছিল একসময়। খেজুর গাছ পরিবেশ বান্ধব একটি বৃক্ষ। বিভিন্ন কারণে এ গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এতে কমে যাচ্ছে গুড়ের উৎপাদনও।
তিনি আরও জানান, জেলায় ৪ হাজার ২৫০টি খেজুরের গাছ রয়েছে। শীত মৌসুমে খেজুর রস ও গুড় বিক্রি করে কৃষকেরা আর্থিকভাবে লাভবান ও স্বাবলম্বী হচ্ছেন। গ্রামীণ অর্থনীতি এবং মৌসুমি কর্মসংস্থানে খেজুর গাছের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। চলতি বছরে ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৫০ কেজি খেজুরের গুড়ের বাজার মূল্য প্রায় ২ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি, তারা যেন বেশি পরিমাণে খেজুরের গাছ লাগান।
মাসুদ