ঢাকা     রোববার   ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৭ ১৪৩১

রাবিতে নির্মাণাধীন ভবন ধস

আবারও আলোচনায় রূপপুরের বালিশ কাণ্ডের ঠিকাদার

রাজশাহী প্রতিনিধি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ৩১ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৩:৪৫, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
আবারও আলোচনায় রূপপুরের বালিশ কাণ্ডের ঠিকাদার

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) নির্মাণাধীন আবাসিক হলের ছাদ ধসে শ্রমিক আহতের ঘটনায় আবারও আলোচনায় এসেছে রূপপুরের বালিশ কাণ্ডের আলোচিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। নির্মাণকাজের সময় শ্রমিকের জীবন বিপন্ন করায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অস্বাভাবিক মূল্যে পণ্য সরবরাহ করে আলোচনায় এসেছিল এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর প্রতিষ্ঠানটি এখন রাজশাহীতে ঘাঁটি গেড়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ (রুয়েট) কয়েকটি বড় বড় প্রকল্পের কাজ পেয়েছে বহুল বিতর্কিত এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কোনকিছুর ধার না ধেরে প্রতিষ্ঠানটি নিম্নমানের কাজ করছে বলেও ইতোমধ্যে অভিযোগ উঠেছে।

রাবির প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, ৫১০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় ১০তলা শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান হল এবং ২০তলা বিজ্ঞান ভবন নির্মাণের কাজ পেয়েছে মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন। হল নির্মাণের ব্যয় ৭০ কোটি ২০ লাখ টাকা। আর বিজ্ঞান ভবনের ব্যয় ১৭১ কোটি টাকা। নির্ধারিত সময়ে কাজ করতে না পেরে ইতোমধ্যে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) শহীদ কামারুজ্জামান ভবনের সামনের অংশের তৃতীয় তলায় কাজ চলছিল। হঠাৎ শাটারিংসহ ছাদটি ধসে পড়ে। এতে পাঁচ শ্রমিক আহত হন। আগের দিন সোমবার এই ছাদের ঢালাই দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলীর অনুপস্থিতিতেই কাজ চলছিল সাইটে। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক জানিয়েছেন, তিনি রাজশাহীর বাইরে গিয়েছিলেন বলে কাজ বন্ধ রাখতে বলেছিলেন। তিনি ফেরার পর ঢালাই হবে বলেও জানিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরও তার অনুপস্থিতিতে কাজ চলছিল।

ঝুঁকিপূর্ণভাবে কাজ করে শ্রমিকের জীবন বিপন্ন করায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগের উপ-মহাপরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনার পরই একজন কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি দেখে এসেছেন। বৃহস্পতিবার আমি নিজে দেখতে যাব। তারপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের অপরাধ বিবেচনা করে মামলা পর্যন্ত করতে পারি।’

পড়ুন: রাবিতে নির্মাণাধীন হলের ছাদে ধস, আহত ৯

এদিকে, ছাদ ধসে পড়ার পর মঙ্গলবার রাতে জরুরি সভায় বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সভা শেষে রাতে জনসংযোগ দপ্তর জানিয়েছে, ‘ছাদ ধসে পড়ার কারণ নির্ধারণ ও নির্মাণাধীন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান আবাসিক হলের যেসব কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলোর গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।’

তদন্ত কমিটিতে রুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুজ্জামান সরকারকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। অন্য দুই জন হলেন- গণপূর্ত বিভাগ-১ রাজশাহীর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. রাশেদুল ইসলাম এবং রাবির প্রকৌশল বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ইমরুল হাসান। সাত কার্যদিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়াও দুর্ঘটনা ঘটনা নিয়ে বুধবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেল ৫টার মধ্যে রাবির প্রধান প্রকৌশলী, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আলাদা আলাদাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলামের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

জনসংযোগ দপ্তর আরও জানায়, আহত শ্রমিকদের খোরপোষসহ চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করাসহ কোনো কিশোর শ্রমিককে ভবন নির্মাণের কাজে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত হয়। সভায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও ছিলেন।

নির্দেশনা অনুযায়ী দুর্ঘটনার বিষয়ে উপ-উপাচার্যের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমার প্রতিবেদন আমি দিয়েছি। নির্মাণপ্রতিষ্ঠান এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী প্রতিবেদন দিয়েছেন কি না তা জানি না।’ প্রতিবেদনে কী উল্লেখ করা হয়েছে সে বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি প্রধান প্রকৌশলী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ‘আজকেই আমাদের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভা চলছে। আমি সভায় আছি। রিপোর্ট আসার কথা। কিন্তু এসেছে কি না, তা আমি জানি না। রিপোর্ট এলে কী ধরনের তথ্য এসেছে, সেটাও বলতে পারব না।’

রাবিতে শুরু থেকেই নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করেই কাজ করে যাচ্ছে বিতর্কিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন। এই প্রতিষ্ঠানটি যে ২০তলা ভবন নির্মাণের কাজ করছে তার মালামাল পরিবহনের ট্রাকের নিচে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি চাপা পড়েন মোটরসাইকেল আরোহী দুই শিক্ষার্থী। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবীব। আহত হন মাহমুদ হাবীবের সহপাঠী রায়হান প্রামাণিক। ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে থাকা পাঁচটি ট্রাকে আগুন দেয়। এই ঘটনার পর ক্যাম্পাসে রাতে ট্রাক চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়।

পরে এই নির্মাণাধীন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান হলে কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ইউনুস আলী নামের এক শ্রমিক মারা যান। গত বছরের ২৬ অক্টোবর এ ঘটনা ঘটে। এর আগে, নির্মাণাধীন ২০তলা একাডেমিক ভবনে কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সাগর নামের আরেক শ্রমিক মারা যান। ২০২২ সালের ৩১ মে এ ঘটনা ঘটে।

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন’ প্রকল্পের পরিচালক খন্দকার শাহরীয়ার বলেন, ‘এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির কাজের সময় পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ঘাটতি আছে। এ জন্য ট্রাকচাপায় আমাদের এক শিক্ষার্থী মারা গেল। আরেকজন গুরুতর আহত হলো। বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মৃত্যুর ঘটনা আছে। এবার কয়েকজন শ্রমিক মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এল। মৃতদের ব্যাপারে তার পরিবারকে আমরা ক্ষতিপূরণ নিয়ে দিয়েছি, কিন্তু টাকা দিয়ে তো জীবনের মূল্য দেওয়া যায় না। আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আগেও দুইবার সতর্ক করেছি। তারপরও তারা সতর্ক হয়নি বলেই আবার দুর্ঘটনা ঘটল।’

এদিকে, ভবনের ছাদ ধস ও শ্রমিক হতাহতের দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের- এ অভিযোগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ বাম সংগঠন। বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে এ অভিযোগ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সব ক্ষয়ক্ষতির দায় নিশ্চিতভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবিলম্বে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের পরিবারের জন্যে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায় করে প্রদান করতে হবে। ভবন ধস ও ধারাবাহিক ছাত্র-শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন’র নামে মামলা ও শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ভবন ধস ও শ্রমিক হতাহতের ঘটনা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় নয়। একই ভবনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শ্রমিক ইউনুস আলী, আরেক নির্মাণাধীন ২০তলা অ্যাকাডেমিক ভবনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শ্রমিক সাগর এবং নির্মাণসামগ্রী বহনকারী ট্রাকের চাপায় শিক্ষার্থী হিমেল ‘হত্যাকাণ্ডের মতো’ ধারাবাহিক ঘটনা ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষয়ক্ষতির আভাসই দিয়ে আসছিল। অথচ লাগাতার ‘হত্যাকাণ্ডের’ পরেও প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বে অবহেলা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ভবনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বেপরোয়া দুর্নীতি, অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে একটি ‘হত্যা কাঠামো’ সৃষ্টি হয়েছে।’

যে ভবনের ছাদ ধসেছে তা ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভবনটির ধসে পড়া অংশে একটি পিলার হেলে গেছে। এই ঘটনায় ভবনের বাকি কাঠামোর স্থায়িত্ব, রডসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর উপযুক্ততা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। অনিরাপদ কাঠামো ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ দুর্ঘটনা বয়ে আনবে। তাই নতুন করে কাজ শুরু করার আগে অবিলম্বে নিরপেক্ষ প্রকৌশল কর্তৃপক্ষ দিয়ে ভবনটির মান যাচাই করতে হবে। এই পরিবেশে শিক্ষার্থীরাও যে নিরাপদ নয়, হিমেল হত্যাকাণ্ড তার প্রমাণ। এমন অনিরাপদ পরিবেশ দীর্ঘায়িত হতে থাকলে আরও ভয়াবহ হতাহতের মুখোমুখি হবো আমরা। তাই নিজেদের এবং সকলের নিরাপত্তার স্বার্থে এ ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

যৌথ বিবৃতি দেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি শাকিল হোসেন, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি রায়হান আলী, নাগরিক ছাত্র ঐক্যের সভাপতি মেহেদী হাসান মুন্না, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের আহ্বায়ক তারেক আশরাফ, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আহ্বায়ক বাবলু চাকমা ও ছাত্র গণমঞ্চের সমন্বয়ক নাসিম সরকার।

কাজে এ ধরনের গাফিলতির বিষয়ে কথা বলতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হায়াত মাহমুদকে মঙ্গলবার ও বুধবার কয়েক দফা ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। তাই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

কেয়া/এনএইচ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়