নারায়ণগঞ্জে কারখানার বর্জ্যে প্রাণ হারাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদ
নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা || রাইজিংবিডি.কম
নারায়ণগঞ্জের বন্দর, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার ও সোনারগাঁ উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ব্রহ্মপুত্র শাখা নদটি দিনে দিনে দূষণের কবলে পড়ে প্রাণ হারাতে বসেছে। এ নদের দুই তীর ঘেষে গড়ে উঠা কারখানাগুলোর বর্জ্যের পানিতে ধ্বংস হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদ।
স্থানীয়রা জানান, রূপগঞ্জ উপজেলার মুড়াপাড়া সংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদী থেকে শুরু হয়ে ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদটি সোনারগাঁও ও আড়াইহাজার দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বন্দর উপজেলার উপর দিয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিশেছে। সরু এ নদের মাধ্যমে বন্দর, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার ও সোনারগাঁ উপজেলা বিভক্ত। এটি আড়াইহাজার উপজেলার পশ্চিম পাশের প্রায় অর্ধশত গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তাছাড়া সোনারগাঁও ও বন্দর উপজেলার মধ্যবর্তী প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এতে করে নারায়ণগঞ্জ জেলার ৪টি উপজেলার লক্ষাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষও চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
আড়াইহাজার উপজেলা ও রূপগঞ্জের সীমানায় নদের উপরে বালিয়াপাড়া ব্রিজ এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, উত্তর দিক থেকে আসা ব্রহ্মপুত্র নদের পানি একেবারে কুচকুচে কালো। সমানতালে নদীতে পড়ছে মিল কারখানা ও ডাইং কারখানার বর্জ্যের পানি। বিষাক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে নদের পানি ব্যবহার করতে পারছে না এলাকাবাসী।
১০/১৫ বছর আগেও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি দিয়ে হাজার হাজার একর জমিতে বোরো ধানের চাষসহ গৃহস্থালির সব কাজই করতেন কৃষকেরা। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে যে, হরগাঁও এলাকায় সুমন, সাইফুল, রাজু ও জুয়েলসহ প্রায় ১৬টি ডাইং কারখানার বর্জ্যে নদের পানি দূষিত হচ্ছে। তারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ক্ষমতাবলে কারখানাগুলো চালিয়ে আসছে।
আড়াইহাজার দুপ্তারা কালীবাড়ি ও গিরদা এলাকায় ১২/ ১৪টি ডাইং কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। সোনারগাঁ উপজেলা ও নরসিংদী সদর উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের দুই পাড়ে গড়ে উঠা ডাইং কারখানার বর্জ্যেও এই নদের পানি দূষিত হচ্ছে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এ দূষিত পানি সোনারগাঁ উপজেলা দিয়ে মেঘনায় মিশে গেছে।
বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দ এলাকার সুবল চন্দ্র দাস বলেন, প্রতি বছর এই নদে আমরা আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন স্নান করি। এখানে দেশ বিদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে স্নানোৎসবে অংশ নেয়। আগে এই নদের পানিতে গোসল করাসহ নিত্য নৈমিত্তিক কাজ করতাম। এখন কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে পানি নষ্ট হয়ে গেছে। নদীতে প্রচুর মাছও ছিল এখন বর্জ্যের পানিতে সব শেষ হয়ে গেছে এখন আর মাছও নাই গোসল করার সুযোগও নাই। ব্রহ্মপুত্রের এই অবনতির পিছনে একমাত্র ডাইং কারখানা ও বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানাগুলোই দায়ী।
রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল এলাকার মেরাজ মোল্লা বলেন, আগে আমরা এই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতাম। কারখানার পানিতে নদীর পানি দূষিত হওয়ায় এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। নদীর পানি কালো বর্ণ হয়ে গেছে।
সোনারগাঁয়ের পঞ্চমীঘাট এলাকার আব্দুর রহিম বলেন, ডাইং কারখানার রঙিন পানিতে নদীর পানি পচে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এই পানি লাগলে শরীর চুলকায়। আগে পানি দিয়া দুই ধারের জমিতে বোরো ধানের ব্যাপক চাষ হইত। কিন্তু পানি দূষিত হওয়ায় ধান চাষ করা যায় না। এই পানি জমিতে দিলে ফসল নষ্ট হয়ে যায়।
বন্দরের সাবদী এলাকার রতন মিয়া বলেন, বর্ষা মৌসুমে অন্য জায়গা থেকে কিছু মাছ এই নদীতে আসলেও কয়েক দিন থাকার পর মইরা ভাইসা ওঠে। নদীটাকে বাঁচাইতে এ পর্যন্ত কারও কোনো উদ্যোগ আমরা দেখি নাই।
পরিবেশ ও নদী রক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। কিন্তু এই দেশের কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের জন্য নদীগুলো ধ্বংস হচ্ছে। নদীগুলো দখল দূষণের কবলে পড়ে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। নদী বাঁচাতে দেশের সরকারের পাশাপাশি সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে।
বন্দর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এম এ মুহাইমিন আল জিহান বলেন, নদী দূষণে যে সকল কারখানা জড়িত; তাদের সনাক্ত করে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আড়াইহাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, যেসব কারখানা থেকে রং মিশ্রিত পানি নদে ফেলা হচ্ছে, প্রথমে ওই সব কারখানা বন্ধ করা হবে। পরে নরসিংদীর কারখানাগুলো বন্ধ করার চেষ্টা চালাতে হবে। নদ রক্ষা বিষয়ে উপজেলা পরিষদের সভায় আমরা আলোচনা করেছি এবং তাতে জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত
নেওয়া হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, নদী রক্ষায় আমরা সবসময় মনিটরিং করি। তবে প্রতি বছর দু'বার আমরা সরেজমিনে অভিযান চালাই। নদী দূষণের ক্ষেত্রে যেসকল কারখানা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই আমরা অভিযান পরিচালনা করবো।
অনিক/ফয়সাল