ঢাকা     রোববার   ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৭ ১৪৩১

‘হাস্যোজ্জ্বল ও সাদা মনের মানুষ ছিলেন আলীম সরকার’ 

পাবনা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  
‘হাস্যোজ্জ্বল ও সাদা মনের মানুষ ছিলেন আলীম সরকার’ 

আব্দুল আলীম সরকার

‘আব্দুল আব্দুল আলীম সরকার সবসময় নিজে হাসিখুশি থাকতেন, চারপাশের মানুষকেও আনন্দে রাখার চেষ্টা করতেন। তিনি কারও সঙ্গে কখনও খারাপ আচরণ করতেন না। অমায়িক একজন ভদ্র ও ভালো মনের মানুষ ছিলেন তিনি। সবসময় সাদা কাপড়ের লুঙ্গি ও পাঞ্জারি পরতেন। তার মনটাও ছিল সাদা।’

প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত পাবনার চাটমোহর উপজেলার পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নের বড় গুয়াখড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল আলীম সরকারকে নিয়ে এমনই মন্তব্য এলাকাবাসীর।

স্থানীয় মাজার শরীফের কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধের জের আর কমিটিতে থাকাকালে নিজের হাতে করা মাজারের গেট ভাঙায় বাধা দেয়ায় প্রতিপক্ষের মারধরে প্রাণ হারান আলীম। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় মামলার দায়েরের পর ওই রাতেই প্রধান দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলেন, বড় গুয়াখড়া গ্রামের মৃত আরজান সরদারের ছেলে আফসার আলী মাস্টার (৬৫) ও তার ছেলে টেঙ্গরজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুল হাসান ওরফে খোকন মাস্টার (৪০)।

নিহত আব্দুল আলীম সরকার একই গ্রামের মৃত ইছাহাক সরকারের ছেলে। তিনি মা মালেকা ইছাহাক দারুল আকরাম ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া বড় গুয়াখড়া খানকায়ে সিদ্দিকিয়া ও নওয়াবিয়া দরবার শরীফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

গত শুক্রবার দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে আলীম সরকারের লাশ হস্তান্তর করে পুলিশ। এরপর বিকেলে বাদ আসর গুয়াখড়া রেলওয়ে খেলার মাঠে জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। শেষে বড় গুয়াখড়া সম্মিলিত গোরস্তানে তাকে দাফন করা হয়।

আলীম সরকারের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে গুয়াখড়া মহেলা বাজারে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। তার মৃত্যু সহজে মেনে নিতে পারছেন না কেউ। এ সময় কথা হয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। 

রিপন রহমান নামের এক যুবক বলেন, আলীম ভাই সবসময় সাদা কাপড় পরতেন। হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। কারও সঙ্গে সহজে রেগে কথা বলতেন না। একদিন কারও সঙ্গে পরিচয় হলে সহজে ভুলতেন না।

ঘটনার রাতে যে দোকানে বসে চা পান করেছিলেন আলীম সরকার, সেই চা দোকানি আবু জাফর বলেন, ‘আমার দোকানে চা খেয়ে আলীম বাড়ি যাবে বলে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর শুনি মারামারির কথা। সেখানে গিয়ে দেখি রাস্তার ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। পরে তাকে হাসপাতালে নিলেও বাঁচানো যায়নি। তিনি অনেক ভালো মানুষ ছিলেন।’

বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় শোকে বিহ্বল আব্দুল আলীমের পরিবার। স্ত্রী-সন্তানের মুখে ভাষা নেই। শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন সবাই। আলাপকালে জানা যায়, আব্দুল আলীম সরকার স্ত্রী ও দুই ছেলে রেখে গেছেন। বড় ছেলের নাম আশিকুর রহমান আশিক (৩২) ও ছোট ছেলের নাম আরিফুর রহমান পিয়াস (২৮)। আলীম সরকার পেশায় কৃষক ছিলেন। বড় ছেলে ঢাকার তেজগাঁও কলেজে মনোবিজ্ঞানে মাস্টার্স করছেন। আর ছোট ছেলে চাটমোহর সরকারি কলেজে এইচএসসিতে লেখাপড়া করছেন।

স্ত্রী আনজুয়ারা খাতুন বলেন, ‘তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এখন তিনি নেই। কীভাবে কি করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। তিনি তো কোনো অপরাধ করেননি। তিনি তো কারো ক্ষতি করেননি। তাহলে কেন তাকে এভাবে প্রাণ দিতে হলো?’

বড় ছেলে আশিকুর রহমান আশিক বলেন, ‘আমার বাবা কারও উপকার ছাড়া ক্ষতি করেননি। ভালবাসা দিয়ে এলাকার মানুষকে একসঙ্গে বেঁধে রাখতেন। সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করতেন। অথচ এমন একজন মানুষকে তার বাঁচতে দিল না। আমরা জড়িতদের ফাঁসি চাই।’

নিহতের বড় ভাই গুলজার সরকার জানান, বিগত ১১ বছর ধরে বড় গুয়াখড়া খানকায়ে সিদ্দিকিয়া ও নওয়াবিয়া দরবার শরীফের কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তার ভাই আলীম। হঠাৎ করেই হার্টের সমস্যা হওয়ার কারণে দায়িত্ব দেওয়া হয় আজাহার সরকারকে। তারপর থেকে কমিটি চলমান ছিল।

তিনি বলেন, প্রায় তিন মাস আগে আফসার আলী মাস্টার নিজেকে সাধারণ সম্পাদক করে গোপনে কমিটি গঠন করেন। এটি জানাজানি হলে সবাইকে নিয়ে কমিটি করার কথা বলেছিলেন আলীম। আর সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে আলীম মাজারের গেট নির্মাণ করেছিলেন। আফসার মাস্টার সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় তার ছেলে খোকন মাস্টার সেই গেট ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেন। এসব নিয়ে আলীম সরকারের সঙ্গে আফসার মাস্টার ও তার ছেলে খোকন মাস্টার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।

মামলা সুত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মহেলা বাজারে চা খেতে যান আব্দুল আলীম সরকার। সেখানে চা খাওয়া শেষে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে বড় গুয়াখড়া গ্রামের মাজার শরীফ গেটের সামনে পৌঁছালে পূর্বপরিকল্পিতভাবে অভিযুক্ত আফসার আলী মাস্টার ও তার ছেলে কামরুল হাসান ওরফে খোকন মাস্টারসহ তাদের সহযোগীরা আলীমকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। তাদের গালিগালাজ করতে নিষেধ করলে খোকন মাস্টার উত্তেজিত হয়ে আলীমকে ধাক্কা দিলে তিনি রাস্তার ওপর পড়ে যান। তখন অভিযুক্তরা আলীমকে কিল ঘুষি মারতে থাকে। তাদের মারধরের এক পর্যায়ে আলীম সরকার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

এ সময় আশপাশের লোকজন ও আলীম সরকারের ছেলে আশিকুর রহমান আশিক ঘটনাস্থলে এগিয়ে গেলে অভিযুক্তরা পালিয়ে যান। পরে অজ্ঞান অবস্থায় আলীম সরকারকে উদ্ধার করে দ্রুত চাটমোহর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনায় নিহতের ভাই গোলজার হোসেন সরকার বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার রাতেই চাটমোহর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৪/৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।

চাটমোহর থানার ওসি সেলিম রেজা বলেন, মামলার পর আফসার মাস্টার ও তার ছেলে খোকন মাস্টারকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার দুপুরে নিহতের লাশ পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
 

শাহীন/বকুল 

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়