লক্ষ্মীপুরের ইটভাটা
১৩৮টির মধ্যে ৮৪টিরই বৈধতা নেই
জাহাঙ্গীর লিটন, লক্ষ্মীপুর || রাইজিংবিডি.কম
লক্ষ্মীপুরে ১৩৮টি ইটভাটার মধ্যে ৮৪টিরই কোনো প্রকার বৈধতা নেই। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে প্রতি বছরই বাড়ছে নতুন নতুন ইটভাটা।
পরিবেশ অধিদপ্তর লক্ষ্মীপুর জেলা কার্যালয়ের তথ্য সূত্রে জানা যায়, শুধু চলতি মৌসুমে জেলার সদর, রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় আরো ১৭টি অবৈধ ইটভাটা চালু করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- সদর উপজেলায় ৪টি, কমলনগর উপজেলায় ৩টি ও রামগতি উপজেলায় ১০টি। গত মৌসুমে এ জেলায় ইটভাটা ছিল ১২১টি। এর মধ্যে অবৈধ ইটভাটা ছিল ৬৭টি।
বর্তমান মৌসুমে লক্ষ্মীপুর জেলায় ১৩৮টি ইটভাটা চালু রয়েছে। এর মধ্যে ৮৪টি ইটভাটাই অবৈধভাবে চলছে। এগুলোর মধ্যে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় রয়েছে ৪৪টি। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রসহ বৈধতা রয়েছে মাত্র ২২টির। আর অবৈধভাবে চলছে ২২টি। কমলনগর উপজেলায় ইটভাটা রয়েছে ২২টি। এর মধ্যে বৈধতা রয়েছে মাত্র ৯টির, বাকী ১১টিই চলছে অবৈধভাবে। রামগতি উপজেলায় ইটভাটা রয়েছে ৪৫টি। এরমধ্যে মাত্র ২টির বৈধতা থাকলেও বাকী ৪৩টিই অবৈধ। রামগঞ্জ উপজেলায় ২৫টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টির বৈধতা থাকলেও অবৈধভাবে চলছে ৮টি। রায়পুরায় ৪টি ইটভাটা রয়েছে। এই ৪টিরই বৈধতা রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর লক্ষ্মীপুর জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক হারুনুর রশিদ জানান, এই বিপুল সংখ্যক ইটভাটা বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য তিনি জেলা প্রশাসনের নিকট বারবার অনুরোধ জানিয়েও ব্যর্থ হচ্ছেন।
তিনি বলেন, অবৈধ ইটভাটা বন্ধের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের প্রয়োজন হয়। জেলা প্রশাসন সে সহযোগিতা তাকে দিচ্ছেনা। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্বেও তিনি এই অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন না।
তিনি জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর একক ক্ষমতাবলে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে। কিন্তু তাতে তেমন ফল পাওয়া যায়না। তিনি গত দুই বছরে জেলার ১২টি ইটভাটার মালিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। মামলা দায়েরের পর ভাটার মালিকরা আদালত থেকে জামিন নিয়ে এসে আবারও ভাটা চালাচ্ছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর লক্ষ্মীপুর জেলা কার্যালয়ের তথ্য সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি ইটভাটা উর্বর কৃষি জমি নষ্ট করে কৃষি জমি, আবাসিক এলাকা ও বিদ্যালয়ের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে। অধিকাংশেই স্বল্প উচ্চতার ড্রাম চিমনি ব্যবহার হচ্ছে। পোড়ানো হচ্ছে পরিবেশ বিধ্বংসি কাঠ, রাবার ও গাড়ীর টায়ারসহ নিষিদ্ধ সব ধরনের জ্বালানি।এতে ভাটা এলাকায় ধোঁয়া ও দুর্গন্ধে মানুষের বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ধোঁয়ায় পার্শ্ববর্তী ফসলি জমির ফসল ও আবাসিক বাড়ি ঘরের গাছপালা ও টিনের চাল পুড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভাটা এলাকায় জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে চর্মরোগ, ব্রনকাইটিস, হাঁপানী, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগব্যাধি।
অপরদিকে বৈধ-অবৈধ সব ইটভাটাতেই ফসলি জমির উর্বর মাটি (টপ সয়েল্ট) কেটে এনে ইট তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। ফলে ফসলি জমিগুলো গর্ত হয়ে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এ ভাটাগুলোতে ইট পোড়ানোর জন্য স্থানীয়ভাবে গাছ কেটে লাকড়ি তৈরি করা হচ্ছে। একেকটি ভাটায় প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ মণ পর্যন্ত লাকড়ির প্রয়োজন হয় বলে জানিয়েছেন কমলনগর উপজেলার চর সামছুদ্দিন গ্রামের শামীম ইটভাটার মালিক সোহাগ।
কমলনগর উপজেলার চর সামছুদ্দিন গ্রামের শামিম ব্রিক ফিল্ডসহ কয়েকটি অবৈধ ইটভাটায় কাঠ চিড়তে করাত কল বসানো হয়েছে। এ সব ভাটায় মাটি ও কাঠ আনা নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে মালবাহি শত শত অবৈধ ট্রাক্টর। এসব ট্রাক্টরের চাকায় পিষ্ট হয়ে গ্রামীণ কাঁচা পাকা সড়কগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
চর সামছুদ্দিন গ্রামের বাসিন্দা ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কমলনগর উপজেলার নেতা তারেক সোলাইমান জানান, তিনি তার নিজ ফসলি জমির ক্ষতির বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন পরিবেশ অধিদপ্তর হ বিভিন্ন স্থানে ধর্ণা দিয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শামীম ব্রিক ফিল্ডের মালিক সোহাগ জানান, আমি ব্রিক ফিল্ড দিয়ে দুই শত পরিবারের রুটি রুজির ব্যবস্থা করেছি। তারা এখন খেয়ে পরে বাঁচতে পারছে । আমি সরকারকে লাখ লাখ টাকা ট্যাক্স দিচ্ছি এতে দেশের উপকার হচ্ছে। উপকার করতে গেলে সামান্য ক্ষতিতো মেনে নিতে হবেই।
সদর উপজেলার আধার মানিক এলাকার হাজী ব্রিক ফিল্ডের মালিক মাকছুদুর রহমান বলেন, আমরা ২০১৮ সাল থেকে এই ব্রিক ফিল্ড চালিয়ে যাচ্ছি, বার বার লাইসেন্সের জন্য চেষ্টা করেও অদ্যাবধি লাইসেন্স পাইনি। পাশে প্রাইমারি স্কুল থাকায় আমাদের লাইসেন্স দেওয়া হয়না। আমরাতো সরকারকে রাজস্বসহ সব ধরনের ট্যাক্স ও সরকারি-বেসরকারি সবখানে টাকা দিয়ে থাকি।
চর আন্ধারমানিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জামাল উদ্দিন সিহাব বলেন, তার বিদ্যালয়টির তিন পাশেই ব্রিকফিল্ড। এ ছাড়া এই গ্রামে রয়েছে ১০টি ব্রিক ফিল্ড। প্রতিদিন শতশত পিকাপ-ট্যাক্টর ইট, মাটি ও কাঠ বহন করে থাকে। বিদ্যালয়ের পাশের পাকা সড়কটি এখন অস্তিত্বহীন হয়ে আছে। ধুলা ও শব্দ দূষণের কারণে বিদ্যালয়ে পাঠদান করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন অবৈধ ইটভাটার মালিক জানান, ভাটা বৈধ হউক আর অবৈধ হউক জেলা প্রশাসনের এল আর ফান্ডে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হয়। তারা উৎপাদিত ইটের ভ্যাট রীতিমতো পরিশোধ করে থাকেন। এ ছাড়াও বিভিন্নভাবে বিভিন্নস্থানে তাদের চাঁদা দিয়ে ইট পোড়াতে হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান জানান, ইতোমধ্যে কয়েকটি অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অভিযান চালিয়ে সকল অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এল আর ফান্ডে টাকা দেওয়ার ব্যাপারে বলেন, যারা অবৈধ কাজ করে তারা এই ধরনের মিথ্যা অভিযোগ করে আসছে। টাকা নেওয়ার ব্যাপারে আমি এই জেলায় যোগদানের পর থেকে এখন পর্যন্ত আমার কাছে কোনো ধরনের তথ্য নাই।
/টিপু/