ঢাকা     রোববার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

সরকারি খাস জায়গায় দোকান নির্মাণ, বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে!

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩১, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  
সরকারি খাস জায়গায় দোকান নির্মাণ, বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে!

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার সুহিলপুর গরুর বাজারে সরকারি খাস জায়গায় ইজারা ছাড়াই দোকান নির্মাণ করে চড়া দামে বিক্রি করছে একটি চক্র- এমন অভিযোগ উঠেছে। এতে করে গরুর বাজারটি সংকুচিত হয়েছে। পাশাপাশি চক্রটি গরুর বাজার সংলগ্ন কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পূর্ব পাশে হ্যালিপ্যাডের সরকারি জায়গাটিও ইজারা নিয়ে সেখানে দোকানপাট নির্মাণ করে বিক্রি করছে। এসব কর্মকাণ্ডে স্থানীয় চার জনপ্রতিনিধির আত্মীয়-স্বজনসহ তাদের ঘনিষ্ঠজনেরা জড়িত বলেও অভিযোগ উঠেছে। প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে নির্মাণকাজ চলমান থাকলেও প্রশাসন নির্বিকার।

এদিকে গরুর বাজারে অবৈধভাবে দোকান নির্মাণের ঘটনায় গত ২২ জানুয়ারি সুহিলপুর গ্রামের আরিফুল হক চৌধুরী, একই এলাকার আবদুল ছোবান, মো. কামাল ও শামিম জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)-এর নিকট লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, সুহিলপুর গরুর বাজারের উত্তর দিকের জায়গা দখল করে একটি প্রভাবশালী চক্র বেআইনিভাবে স্থায়ী স্থাপনা (দোকান ঘর) নির্মাণ করছেন। এতে করে গরুর বাজার সংকোচিত হয়ে গেছে। দোকানপাট নির্মাণকারীদের কেউ-ই বাজারের ব্যবসায়ী নয়।

এ ছাড়াও আরও অভিযোগ, গরু বাজারের পূর্ব দিকে (কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পূর্ব পাশে) সুহিলপুর আলহাজ হারুন-আল-রশিদ ডিগ্রী কলেজে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য রাস্তাসহ পাশের জায়গা ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত হ্যালিপ্যাডের ভূমি ও অর্পিত সম্পত্তি। সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ ভূঁইয়া গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর রাতে হ্যালিপ্যাডের ভূমিসহ অর্পিত সম্পত্তিতে থাকা কলেজের রাস্তায় ইটের দেয়াল নির্মাণ করে দখল করে নেন। পাশের সরকারি ভূমি থেকে খননযন্ত্রের মাধ্যমে মাটি কাটেন। রাস্তাটির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ ভূঁইয়া হ্যালিপ্যাডের ভূমি থেকে পুরাতন ২ লাখ ইট মাটির নিচ থেকে বের করে লোকজনের কাছে বিক্রি করে দেন।

এদিকে, যাতায়াতের রাস্তাটি বেদখল হওয়ায় কলেজের শত শত শিক্ষার্থী, কলেজ-সংলগ্ন কলেজপাড়া গ্রামের কয়েক শ’ বাসিন্দার যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অভিযোগ রয়েছে, এসব বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ ভূঁইয়া তাদের ‘হেফাজতের মামলা দিয়ে’ জেলে পাঠানোর হুমকি দেন। বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনকে জানালেও তারা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউপি চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মোবারক হোসেন ও শামীম হোসেন নামে একজন সরকারি চাকরিজীবী, সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য নীপা দত্তের স্বামী মিন্টুর রঞ্জন ও আরেকটি সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য সুমি বেগমের স্বামী জাকির হোসেন, ইউপি সদস্য মেজবাহুল হকের ছেলে মো. রকি, স্থানীয় বাবুল মিয়া, কাসেম ও শফিকুল ইসলাম সুহিলপুর গরুর বাজারের উত্তর দিকে সাতটি দোকান নির্মাণ করছেন। এ ছাড়া, গরুর বাজারের পূর্বদিকের খাস খতিয়ানভুক্ত হ্যালিপ্যাডের ভূমিসহ অর্পিত সম্পত্তির ২৫ শতক জায়গা মোবারককে বাণিজ্যিক ইজারা দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। এই দুই জায়গার বিষয়ে মোবারকসহ অন্যদের নাম শোনা গেলেও পেছনে রয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রশীদ। অপরদিকে, প্রায় দুই বছর আগে হ্যালিপ্যাডের পশ্চিম দিকে সরকারি খাসের ৮ শতক জায়গা সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ সভাপতি শফিকুল ইসলাম, সদর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সহ সম্পাদক বকুল মিয়া, স্থানীয় মো. আলামিন ও রাকিব মিয়া বাণিজ্যিক ইজারা নিয়ে দোকান নির্মাণ করে বিক্রি করে দিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুহিলপুর ইউনিয়নের এক ব্যক্তি জানান, গরুর বাজারের উত্তর দিকে নির্মাণ করা প্রতিটি দোকানের জন্য চেয়ারম্যানকে তারা ১২ লাখ টাকা করে দিয়েছেন। চেয়ারম্যান হ্যালিপ্যাডের ২৫ শতক জায়গা মোবারকের নামে নিজের জন্য ইজারা নিয়েছেন। সেখানে দোকান নির্মাণ করে বিক্রি করবেন। হ্যালিপ্যাডের জায়গায় ৭০টি দোকান নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তার। হ্যালিপ্যাডের পশ্চিম দিকের ৮ শতক জায়গায় ১৬-১৮টি দোকান নির্মাণ করে ইতোমধ্যেই তিন লাখ টাকা করে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন সব জেনেও ‘নীরব’।

এ ব্যাপারে হ্যালিপ্যাডের জায়গার ইজারা পাওয়া মোবারক হোসেন জানান, ‘হ্যালিপ্যাডের জায়গা ইজারা পেয়েছি। আর গরুর বাজারের উত্তর দিকের জায়গা ৫-৭ জন মিলে ইজারা পেয়েছেন বলে শুনেছি। সেখানে সাতটি দোকান হবে। এর মধ্যে একটি আমার। বাকি দোকানগুলোর একটি একেকজনের নামে হবে। তবে, এখনো ভাগাভাগি হয়নি।’ 

দোকানের বিনিময়ে কত টাকা দিতে হয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা আমি জানি না। তবে অফিস খরচ তো কিছু লাগবেই। এখনো নির্ধারণ হয়নি কে কত দেবেন। শুনেছি গরুর বাজারের জায়গা ইজারা দেওয়া হয়েছে।’

এ ব্যাপারে সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম জানান, ‘বকুল মিয়া, আলামিন, রাকিবসহ আমরা ৪ জন দুই বছর আগে আট শতক জায়গা ইজারা নিয়েছি। জায়গাটি গর্ত ছিল। ভরাট করে আধা-পাকা স্থাপনা নির্মাণ করার অনুমতি নিয়েছি। ১০-১২টি দোকান নির্মাণ করেছি। এখানে আমার তিনটি দোকান রয়েছে। আমি কোনও দোকান বিক্রি করিনি। আর সুহিলপুর গরুর বাজারের দোকান নির্মাণের সঙ্গে আমি জড়িত নই।’

সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ ভূঁইয়া বলেন, ‘আমার নামে ইজারা আছে এমন প্রমাণ বা কাগজপত্র কেউ দেখাতে পারবে না। বাজারের ক্ষতিগ্রস্তসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীদের গরু বাজারের উত্তর দিকের জায়গা দেওয়া হয়েছে। হ্যালিপ্যাডের জায়গা কয়েকজনের মধ্যে ইজারা দেওয়া হয়েছে। হ্যালিপ্যাডের ২৫ শতক জায়গা মোবারকের নামে, আট শতক জায়গা শফিকসহ কয়েকজনের নামে ইজারা দেওয়া হয়েছে। এসবের সঙ্গে আমি জড়িত নই।’

জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ সেলিম শেখ বলেন, ‘গরু বাজারের জায়গা কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি। স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগ পেয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। কেউ যদি সরকারি জায়গায় স্থাপনা নির্মাণের কাজ অব্যাহত রাখে, তাহলে তারা বিপদে পড়বে। তবে, ওই জায়গা ইজারা নেওয়ার জন্য ১০ জন আবেদন করেছেন। হ্যালিপ্যাডের জায়গা কয়েক জনের কাছে বাণিজ্যিক ইজারা দেওয়া হয়েছে। সেখানে দেয়াল নির্মাণ করতে পারবেন, তবে ছাদ দিতে পারবেন না।’ 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি সরকারি জায়গা কিনেন এবং বিক্রি করেন, তারা বিপদে পড়বেন।’

মাইনুদ্দীন/এনএইচ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়