ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

টিটিই মিঠুর আন্তরিকতায় চলন্ত ট্রেনে অসুস্থ রোগীর সেবায় ছুটলেন সবাই

শাহীন রহমান, পাবনা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ০৯:৪৩, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
টিটিই মিঠুর আন্তরিকতায় চলন্ত ট্রেনে অসুস্থ রোগীর সেবায় ছুটলেন সবাই

ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে নীলফামারীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেন। হঠাৎ চলন্ত ট্রেনে অসুস্থ হয়ে পড়েন এক তরুণী। প্রচণ্ড কোমর ব্যথা সঙ্গে বমি, হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল তার।

তরুণীর সঙ্গে থাকা চাচা-চাচি উদ্বিগ্ন। চাচা সহযোগিতা চাইলেন ট্রেনের টিটিই’র কাছে। সেই টিটিই’র আন্তরিকতা আর চেষ্টায় ট্রেনে থাকা কয়েকজন চিকিৎসক, নার্স মিলে সুস্থ করে তোলেন সেই তরুণীকে।

গত সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা-সৈয়দপুরগামী চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে এমন এক মানবিক ঘটনা ঘটেছে। চলন্ত ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ তরুণীর চিকিৎসায় যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে সহযোগিতায় এগিয়ে গেছেন সবাই।

সুস্থ হয়ে ওঠা তরুণীর নাম সুমনা আক্তার (১৯)। তিনি নীলফামারী সদর উপজেলার পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের পূর্ব চেংমারি গ্রামের মোক্তাহারুল ইসলামের মেয়ে। এ বছর এইচএসসি পাশ করেছেন সুমনা।

সুমনার চাচা মশিউর রহমান বলেন, পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ঢাকায় আমার বাসায় বেড়াতে আসে সুমনা। মাস খানেক থাকার পর সোমবার পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হই। বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে কমলাপুর স্টেশন থেকে চিলাহাটির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় চিলাহাটি এক্সপ্রেস। ট্রেনের জ বগিতে ছিলাম আমরা। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর কোমর ব্যথায় কাতরাতে থাকে সুমনা। ধীরে ধীরে ব্যথা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে পা অবশ হয়ে যাচ্ছিল, বমি করছিল।

ট্রেনের ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, টিকিট চেকিং করছিলাম। মৌচাক স্টেশন পার হওয়ার পর জ কোচের মাঝখানের যাত্রী মশিউর রহমান আমার কাছে সহযোগিতা চাইলেন। বললেন, তার ভাতিজি ভীষণ অসুস্থ। ব্যথার ওষুধ দরকার। তখন ট্রেনে আমাদের কাছে ব্যথার ওষুধ ছিল না। আমি টাঙ্গাইল স্টেশনে ফোন দিলাম। তারা জানাল, ওষুধের দোকান স্টেশন থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে। তাই সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, মেয়েটির চাচা আমাদের কাছে ট্রেনে কোনো ডাক্তার আছে কিনা সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে বললেন। তৎক্ষণাৎ উচ্চস্বরে ঘোষণা করি, একজন মেয়ে যাত্রী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি ডাক্তার থাকেন, তবে আপনার মানবিক সাহায্য কামনা করছি। তখন এক যাত্রী নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে এগিয়ে আসেন। আমি তাকে রোগীর কাছে নিয়ে যাই। তিনি রোগীর চাচা-চাচি এবং রোগীর সঙ্গে কথা বলে তার সমস্যা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন।

‘ট্রেনের পিএ অপারেটরের ঘোষণার পর আরও দু’জন ডাক্তার এবং একজন নার্স সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। তিনজন ডাক্তার মিলে তাকে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। রোগীর প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষে তারা কাছাকাছি কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে বলেন। কিন্তু রোগী যাবেন না। এরপর ডাক্তাররা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কিছু ওষুধের চাহিদা দেন।’ যোগ করেন টিটিই।

আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব রেলওয়ে স্টেশনে ওষুধ সংগ্রহের বিষয়ে যোগাযোগ করলে তারা জানায় সেখান থেকে ফার্মেসি অনেক দূরে, ওষুধ পাওয়া সম্ভব না। ট্রেনের ভেতরেই কোনো যাত্রীর কাছে কাঙ্ক্ষিত ওষুধ আছে কিনা এ ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়ে পিএ অপারেটর ব্যবস্থায় ঘোষণা দিতে বললাম। ঘোষণা শুনে কয়েকজন যাত্রী নিয়ে এলেন ব্যথার ওষুধ। এরপর ডাক্তাররা গরম পানির সেঁক দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন। ক্যান্টিন থেকে গরম পানি এনে সেঁক দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু রোগীর যে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

টিটিই মিঠু বলেন, এরপর ডাক্তাররা ব্যথানাশক সাপোজিটরির ব্যবস্থা করতে বললেন। এবার কোনও যাত্রীর কাছে সাপোজিটরি থাকলে সহযোগিতা চাইলাম। কিন্তু, ব্যথানাশক ট্যাবলেট থাকলেও কারো কাছে সেটা ছিল না। রোগীর চাচা জানালেন, বড়ালব্রিজ স্টেশন এলাকায় তাদের পরিচিত লোক আছে। তাকে বললে ঔষধ পাওয়া যাবে। কিন্তু বড়ালব্রিজ স্টেশনে চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনের স্টপেজ নাই। আবার রোগীর অবস্থা ক্রমশই খারাপের দিকে।

আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, এমতাবস্থায় ট্রেনের পরিচালককে অনুরোধ করলাম, যদি ট্রেনটি একটু ধীরগতি করা যায় তাহলে ডাক্তারের চাহিদামত জরুরি ঔষধগুলো সংগ্রহ করা যাবে। ট্রেন পরিচালক রাজি হলে ঔষধের ব্যবস্থা করতে বললাম। বড়ালব্রিজের বুকিং সহকারী মামুন ভাইকে ঔষুধ নিয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে সাহায্য করতে বললাম এবং আমি বড়ালব্রিজ স্টেশনে ঔষধগুলো নিয়ে দ্রুত ডাক্তারের হাতে বুঝিয়ে দিলাম। দেখলাম, মেয়েটি ঔষধ গ্রহণের পরে কিছুটা ভালো বোধ করছে।

প্রতিক্রিয়ায় আব্দুল আলিম মিঠু বলেন, ট্রেনে এমন অনেক মানবিক ঘটনা ঘটে। অনেকে নানা রকম সমস্যায় পড়েন। আমাদের সহযোগিতা চাইলে আমরা সাধ্যমতো সহযোগিতা করি। মেয়েটির অসুস্থতার বিষয়টিও তেমনি একটি ঘটনা। তবে ভালো লাগার ব্যাপার হলো, মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ, মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছাটা অনেকের মাঝে আছে। এমন কাজ করতে পেরে ভালো লাগছে।

সুমনার চাচা মশিউর রহমান বলেন, ট্রেনের টিটিই থেকে শুরু করে ডাক্তার, নার্স যেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন তাতে সত্যি আমি মুগ্ধ। তাছাড়া, আমার ভাতিজির যে অবস্থা ছিল খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। প্রাথমিক চিকিৎসায় সে সুস্থ বোধ করে। চলন্ত ট্রেনের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে কেমন অবস্থা হয় তা ভুক্তভোগীরা জানে। আর এভাবেই মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়। সবার প্রতি আমাদের ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা জানাই।

তরুণীর চিকিৎসা সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছিলেন পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত চিকিৎসক মো. ফাহিম উদ্দিন, সৈয়দপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মো. শামসুল ইসলাম ও মো. নাজমুল হুদা। তাদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সহযোগিতায় ছিলেন একজন নার্স (নাম জানা যায়নি), চিলাহাটি এক্সপ্রেসের পরিচালক বিশ্বজিৎ রায়, টিটিই আব্দুল আলিম মিঠু, টিটিই আমিরুল হক জাহেদী, এসি অপারেটর দীন ইসলাম, সৈয়দপুর জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল হক, ক্যান্টিন বয় রাকিবুল ইসলাম।

সৈয়দপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক শামসুল ইসলাম বলেন, ট্রেনের মাইকে ঘোষণা শুনে আমরা তিনজন ডাক্তার ছুটে যাই। আমরা ডাক্তাররা তো সেবার জন্য কাজ করি। সে জন্য দায়িত্ববোধ থেকে মেয়েটির চিকিৎসা এগিয়ে গিয়েছি। এছাড়া আমরা যখন যেটা চেয়েছি মেয়েটির চিকিৎসার জন্য মানুষ তাৎক্ষণিক যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে সহযোগিতায় ছুটে এসেছে। এটি ভালো দিক। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের উত্তরবঙ্গের মানুষ একটু বেশি মানবিক, আন্তরিক।

কেআই

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়