গাজীপুরে ১৫ বছরে ফসলি জমি কমেছে ৬ হাজার হেক্টর
রেজাউল করিম, গাজীপুর || রাইজিংবিডি.কম
গাজীপুরে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে পরিবেশ দূষণজনিত কারণে দিন দিন কমছে ফসলি জমির পরিমাণ। গত ১৫ বছরে এই জেলার ৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি কমে গেছে। পোশাক কারখানার তরল বর্জ্য গ্রাস করেছে কৃষিজমি। এছাড়া, ব্যাপক হারে কমেছে মুক্ত জলাশয়। ফলে কমেছে দেশি মাছের উৎপাদন।
কৃষি সম্প্রসারণ অফিস বলছে, ২০০৮-৯ অর্থবছরে গাজীপুর জেলায় কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ২১৫ হেক্টর। বর্তমানে কৃষি জমির পরিমাণ ১ লাখ ৪ হাজার ১৭০ হেক্টর।
মৎস্য অফিস বলছে, এক যুগ আগেও গাজীপুরে মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ছিল ২০ হাজার ৩৬১ মেট্রিক টন। বর্তমানে মাছের উৎপাদন কমে দাড়িয়েছে ১ হাজার ৯৫৩ টন।
গাজীপুর মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে থাকা শত শত শিল্প কারখানার তরল বিষাক্ত পানি পরিশোধন ছাড়াই ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দূষিত সেই পানি গিয়ে পড়ছে তুরাগ নদ ও খাল-বিলে। কারখানার বর্জ্য ও দূষিত পানিতে আশপাশের ফসলি জমি ও ফসল নষ্ট হচ্ছে। একসময় যেখানে বিঘায় ২০-২২ মণ ধান হতো। সেখানে এখন ধানের সঠিক ফলন হয় না। সবজি চাষেও কৃষকরা পেতেন দারুণ ফলন। বর্তমানে নদী ও বিলের কালো ও দুর্গন্ধ পানি ব্যবহার করা হয় না। ফলে সবজি উৎপাদনও কমেছে। এছাড়া, কিছু এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায় কমেছে ফসলি জমি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী, বিসিক, কড্ডা, বাইমাইল, সদর উপজেলার মনিপুর, টঙ্গীর বিসিকসহ বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তুরাগ নদীতে। এসব নদীর পানি কালো বর্ণ ধারণ করেছে। দখল ও দূষণের ফলে সংকীর্ণ হয়েছে নদী, হারিয়েছে প্রবাহের গতি। এক সময় এসব নদী ও বিলে পাওয়া যেত অসংখ্য দেশি প্রজাতির মাছ। এসব মাছের সঙ্গে জড়িত ছিল হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকা। নদী ও বিলের পানি রান্নার কাজ ছাড়াও মানুষ কৃষি, কাপড় ধোয়া, গোসল করাসহ প্রায় সব কাজে ব্যবহার করতো। ওই সময় নদীতে ছিল স্বচ্ছ পানির ঢেউ। বর্তমানে গাজীপুরে গড়ে উঠা বিভিন্ন শিল্পকারখানার দূষিত তরল বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে তুরাগ নদীতে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, একসময় গাজীপুরের মুক্ত জলাশয়ের বাহারি সুস্বাদু মাছ পাওয়া যেতো। খাল-বিল ও নদী-নালায় মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন প্রান্তিক জেলেরা। কিন্তু, বর্তমানে দূষণে মুক্ত জলাশয়ের মাছের পরিমাণ দিন দিন কমে গেছে। এতে বিপাকে পড়ছেন পেশাদার মাছ আহরণকারীরা। সাধারণ মানুষও প্রাকৃতিক জলাধারের স্বাস্থ্যকর মাছ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গাজীপুর মৎস্য অফিসের সহকারী পরিচালক জান্নাতুল শাহীন বলেন, গাজীপুরে ১ হাজার ৭২০ হেক্টর বিল রয়েছে। তুরাগ ও বংশাইসহ ১০টি নদীর ১ হাজার ৭৫৩ হেক্টর জলাশয়ে বছর ২ হাজার ৩২৩ মেট্রিক টন দেশি মাছ উৎপাদন হওয়ার কথা। কিন্তু গেল ১৪ বছরে মাছের উৎপাদন কেবলই কমছে। এর জন্য দায়ী কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য। সুস্বাদু দেশি মাছের উৎপাদন ফিরিয়ে আনতে হলে প্রশাসনের সব বিভাগের সমন্বয় জরুরি।
গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ২০০৮-৯ অর্থবছরে এই জেলায় কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ২১৫ হেক্টর। বর্তমানে কৃষি জমির পরিমাণ ১লাখ ৪ হাজার ১৭০ হেক্টর। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানার দূষণের কারণে ফসলি জমি কমে যাচ্ছে।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নয়ন মিয়া বলেন, গাজীপুরে ২ হাজারের বেশি পোশাক কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে ৬০০ ডাইং কারখানায় ইটিপি বা বর্জ্য শোধনাগার রয়েছে। কিন্তু, গাজীপুরের সমস্ত খাল বিল ও নদীর দিকে তাকালেই দেখা যায়, এসব ইটিপি নিয়ম মেনে চালানো হয় না। পোশাক কারখানা বহাল রেখে নদী ও বিলে বিশুদ্ধ পানি মিলবে না। বিভিন্ন সময়ে কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চলানো হয়। এখন পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে অনেক কারখানার বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করা হয়েছে। অনেকের গ্যাস সংযোগ বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া, জরিমানাও করা হয়েছে।
মাসুদ