ঢাকা     শনিবার   ২৯ জুন ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৫ ১৪৩১

‘এতো টাকা দিয়ে মাংস কিনলে অন্য বাজার আর করাই যাবে না’

মাসুম লুমেন, গাইবান্ধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৯, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৭:২৩, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
‘এতো টাকা দিয়ে মাংস কিনলে অন্য বাজার আর করাই যাবে না’

ক্রেতা না থাকায় পত্রিকা পড়ে সময় কাটাচ্ছেন এক মাংস বিক্রেতা

‌‘এখন সবকিছুরই দাম বেশি। আগে সপ্তাহে একদিন বাড়িত মুরগি কিনি নিয়্যা গেছি। আর দুই-একদিন কম সিলভার, পাঙ্গাশ মাছ কিনি নিয়্যা গেছি। কিন্তু, এখন মাসেও আর মুরগি কেনা যায় না। যে বোলডার (ব্রয়লার) আগে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা ছিল, সেই মুরগিও এখন দুইশো টাকার ওপরে। চাল, ডাল, তেল, আদা, রসুনের দাম অনেক বেশি। মাংস খেতে গেলে এসব লাগে। গরু-খাসির মাংস কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া খাওয়া হয় না।’ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের দশানি গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান বাবু। 

গরুর মাংস কিনতে বাজারে এসেছেন এনজিও কর্মী সুইট সরকার। রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘আগে বাজারে এলে এক মাসে কমপক্ষে ৫ কেজি গরুর মাংস কিনতাম। এখন সব ধরনের মাংসের দাম বেশি। তাই ২ কেজি কিনেছি। অন্যান্য পণ্য কিনতে আরও টাকা লাগবে। আমরা নির্দিষ্ট বেতন পাই। এই স্বল্প বেতনে বাধ্য হয়েই মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি।’ 

রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টায় শহরের পুরাতন বাজারে সরেজমিন গিয়ে কথা হয় সদর উপজেলার পূর্ব কোমরনই মিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এবং শহরের পুরাতন বাজারের গরুর মাংস ব্যবসায়ী সিদ্দিক, মাজেদ, ইকবাল ও নুর আলমের সঙ্গে। রাইজিংবিডিকে তারা বলেন, আগে সারাদিন ১০ থেকে ১১টি গরুর মাংস বিক্রি করতাম। এখন সারাদিন ২ থেকে ৪টি গরু জবাই করে ৮ থেকে ১০ জন কসাই মাংস ভাগ করে নিয়ে বিক্রি করি। মানুষের আয় কমে গেছে। হাতে টাকা নেই। 

তারা আরও বলেন, হাট থেকে চড়া দামে গরু কিনতে হয়। ৭০০-৭৫০ টাকা দিয়ে সবাই মাংস কিনতে পারে না। তাই, গরুর মাংস বিক্রি অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। কর্মচারীদের বেতন দিতেই কষ্ট হয়। মনে হয়, আগের তুলনায় শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ গরুর মাংস কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। 

পৌর শহরের ব্রিজরোড কালিবাড়ি পাড়ার খাসির মাংস ব্যবসায়ী সাব্বির মিয়া। তিনি ২০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। ব্যবসায়ীক জীবনে তিনি আগে যে পরিমাণ খাসির মাংস বিক্রি করতেন এখন তার চেয়েও কম মাংস বিক্রি করছেন। বাজারে তার মতো আরও দু'জন খাসির মাংস ব্যবসায়ী রয়েছেন। তারা হলেন-শহরের কুটিপাড়ার হাসেম মিয়া ও রাজা মিয়া। 

মাংস বিক্রি কমে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা এই প্রতিবেদককে বলেন, একটা খাসি কিনতে হাটেই কেজি প্রতি ৯০০ টাকার ওপরে লাগে। আমদের ১০০০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করি। একজন সাধারণ মানুষ সারাদিনে আয় করেন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। এই টাকায় খাসির মাংস কেনা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই, আগের তুলনায় খাসির মাংস ক্রেতা একেবারেই কমে গেছে। 

নিম্ন আয়ের অনেক মানুষকেই মুরগির গিলা-কলিজা কিনতে দেখা যাচ্ছে

তারা আরও বলেন, আগে সারাদিনে ১০ থেকে ১২টি খাসির মাংস বিক্রি করেছি। বর্তমানে ৪ থেকে ৫টি বিক্রি কর‍তেও অনেক কষ্ট হয়। মাংস ক্রেতাদের অধিকাংশই এখন মুরগি এবং মুরগির চামড়া, গিলা ও কলিজা কিনে নিয়ে যান। 

শহরের পুরাতন বাজারের মুরগি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গেল একমাস থেকে ব্রয়লার মুরগি ১৯০ থেকে ২২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। লেয়ার মুরগি ২৯০ টাকা কেজি। আর কক মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ২৬০ টাকা থেকে ২৮০ টাকায়। দেশি মুরগি ৫৫০ টাকা এবং হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা কেজি দরে।  

মাছের বাজারের দৃশ্যও অনেকটা একইরকম। কম দামের মধ্যে একমাত্র দেশি মুসা মাছ ২০০ টাকা কেজিতে পাওয়া যাচ্ছে। আর পাঙ্গাস, তেলপিয়া, যা আগে ১৫০ টাকা কেজি ছিল, তা এখন রকমভেদে ২২০ থেকে ২৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। সুস্বাদু রুই, কাতল, চিংড়ি ও দেশি মাছ ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর আকারভেদে ইলিশ কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকায়।

বাজারে সন্তানদের জন্য মুরগি কিনতে এসেছিলেন শহরের ব্রিজরোডের বাসিন্দা রোজী বেগম। স্বামীর সীমাবদ্ধ আয়ের কথা উল্লেখ করে রাইজিংবিডিকে তিনি বলেন, ‘আগে ছোট ছেলে-মেয়েদের মুরগিই কিনে খাওয়াতাম। কিন্তু এখন মুরগি কিনতে গেলে ওজনভেদে ৫০০ টাকার উপরে পরে। গরুর মাংস, খাসির মাংসের দাম অনেক বেশি। তাই, মুরগির চামড়া, পাখা, গিলা-কলিজা কিনছি। বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ, দুধ-ডিম সবকিছুতেই খরচ বেড়ে গেছে। এতো টাকা দিয়ে মাংস কিনলে অন্য বাজার আর করাই যাবে না।’

বেসরকারি একটি হাসপাতালের ফার্মেসির বিক্রয় প্রতিনিধি চন্দন কুমার বাজারে খাসির মাংস কিনতে এসেছিলেন। হিসাব না মেলায় মাছ কিনেছেন। আর বাকি টাকায় মুরগির গিলা কলিজা কিনেন তিনি। নিজের অসহায়ত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কি করবো। মায়ের অসুখ। ডাক্তার, ওষুধ এবং হাসপাতালের খরচ মেটাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাকে ভালো-মন্দ খাওয়াতে হয়। ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচ কমানো সম্ভব নয়। তাই খাবারের খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছি।’ 

মুরগির গিলা-কলিজার দাম নিয়ে বিক্রেতাদের সঙ্গে অনেকটা হৈ-হুল্লোড় করছিলেন সদর উপজেলার পুলবন্দি এলাকার বৃদ্ধা সুফিয়া বেওয়া। তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগেও এই পুরাতন বাজারে গিলা কলিজা এক কেজি ১৪০ টাকায় কিনচ্যি। আজকে সেই গিলা কলিজার দাম চাচ্ছে ১ কেজি ১৮০ ট্যাকা! তাও আবার বাছি (বেছে) নিব্যার দিব্যের নয়।’ 

মুরগি না কিনে কেন গিলা-কলিজা কিনছেন জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গৃহবধূ বলেন, এক কেজি মুরগি ২২০ টাকায় কেনার পর মাংস পাওয়া যায় মাত্র ৬০০ গ্রাম। আর এক কেজি গিলা কলিজা ১৮০ টাকায় কেনা যায়। যার কোনকিছুই ফেলতে হয় না। সেজন্য গিলা-কলিজা কিনলেই বেশি লাভ। 

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়