নিপাহ নয়, অজানা ভাইরাসেই রাজশাহীর ২ শিশুর মৃত্যু
রাজশাহী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
রাজশাহীতে শিশু মুনতাহা মারিশা (২) ও মুফতাউল মাসিয়া (৫) অজানা ভাইরাসেই মারা গেছে। তাদের শরীর থেকে সংগ্রহ করা নমুনা ঢাকায় পরীক্ষা শেষে এতথ্য নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল।
ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, নমুনা সংগ্রহ করে তারা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে সেই রিপোর্ট হাতে পেয়েছেন। রিপোর্টে উল্লেখ আছে, নিপাহ ভাইরাসে তাদের মৃত্যু হয়নি। কোন ভাইরাসে তাদের মৃত্যু হলো, সেটি নিশ্চিত হতে গবেষণা করা হবে।
আরও পড়ুন: অজানা ভাইরাসে রাজশাহীতে ২ বোনের মৃত্যু, বাবা-মা হাসপাতালে
মারা যাওয়া ওই দুই শিশুর বাবার নাম মনজুর রহমান (৩৫) ও মায়ের নাম পলি খাতুন (৩০)। তাদের বাড়ি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার চুনিয়াপাড়া গ্রামে। মনজুর রহমান রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষক। পরিবার নিয়ে মনজুর রহমান ক্যাডেট কলেজের কোয়ার্টারে থাকেন। দুই শিশুকে তাদের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার চুনিয়াপাড়ায় দাফন করা হয়েছে।
রামেক হাসপাতালে মনজুর রহমান-পলি দম্পতির পাশে আছেন তাদের স্বজন রইস উদ্দিন। তিনি বলেন, বাড়িতে মঞ্জুর রহমানের মাকে বাঁচানো দায় হয়ে গেছে। কিছুতেই তার আহাজারি থামছে না। মাঝেমধ্যে তিনি অচেতন হয়ে যাচ্ছেন। তবে, মনজুর রহমানের বাবা শক্ত আছেন।
রইস উদ্দিন হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মারা যাওয়া শিশুদের মা পলি খাতুন আহাজারি শুরু করেন। তাকেও কিছুতেই থামানো যাচ্ছিল না।
রামেক হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, এই দম্পতি নিজেরা বরই খাননি বলে জানিয়েছেন। তারা দুটো বাচ্চাকেই কাছে রেখেছিলেন। শিশুদের মাধ্যমে মা-বাবার শরীরেও ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। এই আশঙ্কায় তাদের হাসপাতালে রাখা হয়েছে। পরীক্ষায় নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত হয়নি। ফলে একটু পর্যবেক্ষণের পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ চত্বরে থাকা গাছের বরই কুড়িয়ে এনে দুই শিশুকে খেতে দিয়েছিলেন গৃহকর্মী। না ধুয়েই সেই বরই খেয়েছিল এই দম্পতির দুই শিশু সন্তান। এরপরই অসুস্থ হয়ে পড়ে তারা। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে শনিবার বিকেল ৫টার দিকে মারা যায় মনজুর রহমান-পলি দম্পতির বড় মেয়ে মাশিয়া। তার আগে গত বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) মারা যায় ছোট মেয়ে মারিশা। দুইজনেরই জ্বর ও বমির মতো একই লক্ষ্মণ ছিল। শনিবার বিকেলে নিকট স্বজনদের মাধ্যমে মাশিয়ার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়। সন্ধ্যার পরে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায় গ্রামের বাড়িতে মরদেহ দাফন করা হয়। গত বুধবার রাতে ছোট মেয়ে মারিশাকেও দাফন করা হয়েছে।
রামেক হাসপাতালের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে থাকা মনজুর রহমান ও তার স্ত্রী পলি খাতুনের অবস্থা এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল। তবে তাদেরকে পাশাপাশি শয্যায় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। শিশুদের বাবা-মাকে আর হাসপাতাল থেকে যেতে দেননি চিকিৎসকরা। তারা দুই মেয়ের দাফনেও অংশ নিতে পারেননি। বর্তমানে এই দম্পতি রামেক হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন।
পলি খাতুন জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে কোয়ার্টারের গৃহকর্মী কলেজ ক্যাম্পাসের গাছ থেকে বরই কুড়িয়ে এনে দুই মেয়েকে খেতে দিয়েছিলেন। সেই বড়ই না ধুয়েই খেয়েছিল মারিশা আর মাশিয়া। সেদিন তারা ভালোই ছিল। একসঙ্গে খেলাধুলাও করেছে। পরদিন বুধবার বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ ছোট মেয়ে মারিশার শরীরে ভীষণ জ্বর আসে। এ সময় তারা বার বার পানি পান করছিল। দুপুর থেকে বমি শুরু হয়। তখন মেয়েকে নিয়ে তারা একটি মাইক্রোবাসে করে রাজশাহীর সিএমএইচ হাসপাতালে আসছিলেন। মাইক্রোবাসেও মারিশা বুকের দুধ পান করে। তবে শহরে অদূরে কাটাখালী এলাকায় মায়ের বুকেই মৃত্যু হয় মারিশার। এরপরও তাকে সিএমএইচে নেওয়া হয়। তবে সেখানে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা জানান, শিশু মারিশা আর নেই। এরপর রাজশাহীর দুর্গাপুরে নিয়ে তার লাশ দাফন করা হয়।
গত শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে মাশিয়ারও শরীরেও জ্বর আসে। একই সঙ্গে শুরু হয় বমি। অবস্থা বেগতিক দেখে দুর্গাপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখান থেকে পরে তাকে রাজশাহী সিএমএইচে নেওয়া হয়। এরপর রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাশিয়ার পুরো শরীরেও ছোপ ছোপ কালশিটা দাগ উঠতে শুরু করে। তা দেখে সিএমএইচের চিকিৎসকরা মাশিয়াকে রামেক হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। রাত ৯টার দিকে তাকে রামেক হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করেন। কিন্তু, আইসিইউতে পর্যবেক্ষণ থাকা মাশিয়াও পরদিন শনিবার বিকেলে মারা যায়। ছোট মেয়ে মারিশা মৃত্যুর পর তার পুরো শরীরে ছোপ ছোপ কালশিটে দাগ উঠতে শুরু করে। আর বড় মেয়ে মাশিয়ারও একই রকম কালশিটে দাগ উঠতে শুরু করে মৃত্যুর আগের রাতে।
কেয়া/মাসুদ