নতুন বাঁধ: বোরো ধানে ভরেছে হাওরের প্রয়াগবিল
রুমন চক্রবর্তী, কিশোরগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
বোরো চাষ নিয়ে এবারের মতো নির্ভার কখনও ছিল না হাওর অধ্যুষিত প্রয়াগবিলের কৃষকেরা। প্রায় প্রতি বছর বোরো আবাদে আগাম বন্যার শিকার হতো তারা। পানিতে তলিয়ে যেত হাজার হাজার মণ ধান। ফসলের নিরাপত্তা না থাকায় অর্ধেকে নেমেছিল বোরো চাষ। পতিত পড়ে থাকত অনেক জমি। কিন্তু স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নতুন বাঁধে, এবার কৃষকের কেটেছে ফসল হারানোর ভয়। এবার সেখানে অন্তত এক হাজার একর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। একটু জায়গাও পতিত নেই। সবুজে ছেয়ে গেছে পুরো বিল।
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার সুতারপাড়া ইউনিয়নের প্রয়াগবিলকে ঘিরে আছে স্রোতস্বিনী ধনু নদী। হাওর অধ্যুষিত প্রয়াগবিলে এখন বোরো ধান চাষ নিয়ে ব্যস্ত কৃষক। প্রয়াগবিলের ফসল রক্ষা বাঁধটি মাটি দিয়ে নির্মিত হওয়ায় ধনু নদীর পানির চাপে প্রায়শই ভেঙে যেত। কৃষকদের দাবি ছিল, টেকসই বাঁধ, যেটি ভাঙবে না। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) টাকায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) একটি টেকসই ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে দিয়েছে প্রয়াগবিলে। কাজও প্রায় শেষ।
স্থানীয়রা বলছে, জেলাজুড়ে অন্যান্য ফসল রক্ষা বাঁধের মেরামত কাজ শেষ হতে এখনও অনেক সময় লাগবে। তবে তাদের বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে পানি আসার অন্তত তিন মাস আগে। এ কারণে তাদের মাঝে আর ফসল হারানোর ভয় নেই।
নতুনভাবে বাঁধটি নির্মিত হওয়ায় খাকশ্রী, দক্ষিণ গণেশপুর, উত্তর গণেশপুর, সাগুলি ও নিয়ামতপুর গ্রামের কয়েক হাজার কৃষক উপকৃত হবেন।
এবারের বাঁধটি সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধাই করে দেয়ায় অনেক খুশি সাগুলি গ্রামের কৃষক জহিরুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও জিয়া উদ্দিন। তারা বলেন, ‘বাঁধটি সিসি ব্লক করায় মাঠের ফসল অনেকটাই নিরাপদ। বড় কোনো প্লাবন বা বন্যা না হলে ধানের ক্ষতি হবে না। তাই আমরাও ভয়ভীতি ভুলে বোরো চাষে ব্যস্ত সময় পার করছি।’ তারা আরও বলেন, হাওরে প্রতি বছর মাটি কেটে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ বা মেরামত না করে, টেকসই বাঁধ নির্মিত হলে কৃষকের বেশি উপকারে লাগবে। বাঁধের জন্য প্রতিবছর দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না। এক বাঁধে বহু বছর চলে যাবে।
সাগুলি গ্রামের আরেক কৃষক জালাল উদ্দিন। এবার প্রয়াগবিলে তিনিই সবচেয়ে বেশি ২৫ একর বোরো ধান চাষ করেছেন। এর আগে পানির ভয়ে ঠিকঠাক চাষাবাদ করতে পারতেন না। কিন্তু এবারের এ বাঁধ তার মনে সাহসের জোগান দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘জীবনে কতবার যে ফসল হারিয়ে কেঁদেছি তার কোনো হিসাব নেই। এইবার আমিসহ সব কৃষকরে মনোবল চাঙ্গা। এ কারণে বিলের সব জমিতেই আমরা চাষাবাদ করেছি। আর এই বাঁধই আমাদের কৃষকদের সাহস জোগাচ্ছে।’
কৃষকরা আরও জানান, এই বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে ‘সাগুলি প্রয়াগবিল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে সংগঠন করেছেন কৃষকরা। এ সংগঠনে বর্তমানে ২৭৫ জন সদস্য রয়েছে। বাকিরাও সদস্য হতে আবেদন করেছে। প্রকল্পের আওতায় তাদের একটি অফিসও স্থাপন করে দেয়া হয়েছে।
করিমগঞ্জের উপজেলা প্রকৌশলী বখতিয়ার হোসেন জানান, বাঁধটির মোট দৈর্ঘ্য ১৯৫০ মিটার। ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) আওতায় বাঁধটি করা হয়েছে। ১৯৯৬ সাল থেকে মাটির বাঁধটি ধীরে ধীরে নির্মাণ করা হয়। তবে এখানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ ছিল ৪৫৬ মিটার। আর মাটির বাঁধটি নদীর পাশে হওয়ায় সেটি বারবার ভেঙে যেত। এবার সেখানে সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধাই করা হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। এখন শেষ পর্যায়ের কাজগুলো করা হচ্ছে। এ বাঁধে এবার কৃষকের ফসলের নিরাপত্তা বাড়বে। তাদের মুখে হাঁসি ফুটবে।
তিনি আরও জানান, বাঁধ ছাড়াও বিলে একটি খাল খনন করা হয়েছে। যেখান থেকে কৃষকরা সেচ সুবিধা পাবে। একই সঙ্গে মাছ চাষও করতে পারবে।
কিশোরগঞ্জে কর্মরত প্রকল্প সংশ্লিষ্ট জাইকার সোসিওলজিস্ট মো. মারুফ উল আলম নতুন বাঁধ নিয়ে দাবি করেন, টেকসই বাঁধ নির্মাণের কারণে এখানকার কৃষকদের ফসলের ঝুঁকি কমেছে। এতে এখানকার কৃষকদের জীবনমান উন্নত হবে। তাইতো প্রায় ঝুঁকিমুক্ত ফসলের নিশ্চয়তা পেয়ে এখানকার কৃষকরা এখন অনেক খুশি।
তিনি মনে করেন, এ ধরণের বাঁধ হাওরের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।
/বকুল/