শ্রেণিকক্ষে ছাত্রকে গুলি
রায়হানের বিরুদ্ধে পাহাড়সম অভিযোগ, এত দিন কথা বলেনি কেউ
অদিত্য রাসেল, সিরাজগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
রায়হান শরীফ। ফাইল ফটো
শ্রেণিকক্ষে ছাত্রকে গুলি করে আলোচনায় আসা সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, শ্রেণিকক্ষে পিস্তল প্রদর্শনসহ সবসময় অস্ত্র নিয়ে ঘুড়ে বেড়ানোসহ পাহাড়সম অভিযোগ উঠেছে।
বুধবার (৬ মার্চ) সরেজমিনে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে গিয়ে জানা যায়, কলেজ ক্যানটিনে গত ১০ মাসে প্রায় ১১ হাজার টাকা বাকি খেয়েছেন রায়হান শরীফ। টাকা চাইলেই গুলি করার ভয় দেখাতেন তিনি।
ক্যানটিন মালিক স্বপন ইসলাম বলেন, টাকা চাইলে রায়হান শরীফ বলতেন, পরে দিব। পরে কখন দিবেন, বললে পিস্তল বের করে ধমক দিতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রায়হান শরীফ সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাকের ছেলে। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে (রামেক)। তিনি রামেক ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন।
সেখানে ইন্টার্নশিপ শেষে সিরাজগঞ্জে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিয়েছিলেন। তবে উগ্র আচরণের কারণে সেখান থেকে চাকরিচ্যুত হন।
ব্যক্তি জীবনে এক নারী চিকিৎসককে বিয়ে করেছিলেন রায়হান শরীফ, তবে সেই বিয়ে টেকেনি। ২০২১ সালে বিসিএস (বিশেষ বিসিএস) দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন তিনি।
সিরাজগঞ্জ শহরের বেসরকারি নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জহুরুল হক বলেন, রায়হান শরীফ ২০১৭ সালে নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজে শিশু বিভাগে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেসময়ও তিনি কলেজে অস্ত্রের ভীতি তৈরি করেছিলেন। পরে শিশু বিভাগের প্রধান ডা. লিয়াকত আলীর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ভয় দেখালে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। এরপর তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. লিয়াকত আলী বলেন, হাসপাতালের একটি দায়িত্ব বণ্টনের বিষয় নিয়ে রায়হান শরীফ আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ভয় দেখিয়েছিল। পরে কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানালে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
শহরের বিএ কলেজ রোড এলাকার এক মুদি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শিক্ষক রায়হান শরীফ পিস্তল দিয়ে সবাইকে ভয় দেখাতেন। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু এর আগে কখনো কাউকে গুলি করেননি। এই প্রথম শুনলাম, এক শিক্ষার্থীকে গুলি করেছেন। অস্ত্র কিনে তা নিজ বাড়িতে সংগ্রহ করে রাখা তার শখে পরিণত হয়ে উঠেছিল।
সিরাজগঞ্জের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আশিক ইমরান বলেন, সম্প্রতি শহরের অভিসিনা হাসপাতালের সামনে শিক্ষক রায়হান শরীফ এক রিকশাচালককে পিস্তল দেখিয়ে ভয় দেখাচ্ছিলেন। আমি সেসময় সেখানে ছিলাম। ভেবেছিলাম তিনি প্রশাসনের লোক।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা কামাল হোসেন বলেন, রায়হান শরীফ একটু রগচটা টাইপের মানুষ। হঠাৎ খবরে দেখলাম, মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীকে গুলি করেছেন।
মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষক শরীফ মাঝে মধ্যে ছাত্রীনিবাসে যেতেন। ছাত্রীদের মাদকদ্রব্য সেবনের আহ্বান করতেন। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান এবং শিক্ষকদের সঙ্গে আড্ডার সময় অস্ত্র বের করে রাখতেন টেবিলের ওপর।
শিক্ষার্থীরা বলেন, তমালকে গুলি করার আগে শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষুব্ধ হন রায়হান শরীফ। তিনি বলেন, তোমাদের কারও কি পোষা পাখি আছে? আমার পোষা পাখি আছে। এই বলে তিনি ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে বলেন, এটা আমার পোষা পাখি। এরপর গুলি ছুড়েন। গুলি তমালের ডান উরুতে লাগে। পরে সহপাঠীরা ৯৯৯ নম্বরে কল দিলে সদর থানা পুলিশ ও জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ঘটনাস্থলে পৌঁছে রায়হান শরীফকে অস্ত্রসহ আটক করে।
উল্লেখ্য, গত সোমবার (৪ মার্চ) বিকেলে ক্লাস চলাকালীন আরাফাত আমিন তমাল (২২) নামের এক শিক্ষার্থীকে গুলি করেন শিক্ষক শরীফ। এ ঘটনার পর অবৈধ অস্ত্র রাখার অপরাধে পুলিশ বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা করে। এছাড়া, আহত শিক্ষার্থীর বাবা আব্দুল্লাহ আল আমিন আরেকটি মামলা করেন। এসব মামলায় শরীফকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বর্তমানে তিনি জেল হাজতে রয়েছেন।
রায়হান শরীফ আদালতে স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, তিনি ওই শিক্ষার্থীকে গুলি করেছেন। তবে, ভয় দেখাতে পিস্তলটি বের করেছিলেন। কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবে গুলি বের হয়ে যায়।
গুলি ছোড়ার ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির সঙ্গেও কথা বলেছেন রায়হান শরীফ। তিনি স্বীকার করেছেন, তার কাছে দুটি পিস্তল আছে। তবে, একটিরও লাইসেন্স নেই। বিভিন্ন সময় আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শনের বিষয়টিও স্বীকার করেছেন তিনি।
বাসে পিস্তল নিয়ে পাশের আসনের যাত্রীকে ভয় দেখাচ্ছেন শরীফ। এই ছবিটি ভাইরাল হয়েছে
ছাত্রীদের রাতে ফোন করে উত্ত্যক্তের বিষয়ে জানতে চাইলে শরীফ তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, ছাত্রীদের পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়াতে এটা করতেন তিনি।
রায়হান শরীফের এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আমিরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা লিখিত কিংবা মৌখিকভাবে কিছুই আমাকে জানায়নি। তবে এই শিক্ষকের এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে অন্যভাবে জেনেছি। পরে তাকে বদলির চেষ্টাও করেছিলাম, কিন্তু হয়নি।
সিরাজগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, রায়হান শরীফকে পৃথক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মঙ্গলবার (৫ মার্চ) বিকেলে সিরাজগঞ্জ অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠানো হয়। পরে বিচারক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করে তাকে কারাগারে পাঠান।
তিনি আরও বলেন, আটকের সময় রায়হান শরীফের কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, ৮১টি গুলি, চারটি ম্যাগজিন ও ১২টি বিদেশি চাকু জব্দ করা হয়।
গুলির ঘটনার পর রায়হান শরীফের সাবেক ও বর্তমান কর্মস্থলে খোঁজ নেন এই প্রতিবেদক। জানা যায়, সার্বক্ষণিক নিজের সঙ্গে পিস্তল রাখতেন তিনি। রামেকে থাকাকালীন শিক্ষার্থীদের মারধর এবং গভীর রাতে ক্যাম্পাসে ফাঁকা গুলি ছুড়তেন।
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর রামেক হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে ইন্টার্ন চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন শরীফ। সেদিন ওই ওয়ার্ডে জয় নামের এক রোগী মারা যান। এর প্রতিবাদ করলে জয়ের স্বজনদের দিকে পিস্তল তাক করেন তিনি।
এ ঘটনার পরে ওই বছরের ১৩ নভেম্বর হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় মহসিন আলী নামে এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। ওই দিন মহসিনের দুই ছেলেকেও পিস্তল দেখিয়ে ভয় দেখান রায়হান শরীফ।
সেসময় মহসিনের স্ত্রী মানববন্ধনে বলেছিলেন, একজন ইন্টার্ন চিকিৎসক আমার ছেলেদের গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। পরে গুলি না করে আমার ছেলেদের পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন। এ ঘটনার পর রামেক হাসপাতালে দুই রোগীকে মারধর করেছিলেন রায়হান শরীফ।
এদিকে, শিক্ষার্থীকে গুলির ঘটনার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বাসে এক যাত্রীর দিকে রায়হান শরীফের পিস্তল তাক করে রাখার ছবি ভাইরাল হয়েছে। তবে ছবিটি কবের বা কোথা থেকে তোলা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
আরও পড়ুন
‘গুলি করার পরেও আরাফাতকে হাসপাতালে নিতে বাধা দিয়েছিল’
শিক্ষক রায়হানের শাস্তির দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
শিক্ষার্থীকে গুলি: সিরাজগঞ্জে স্বাস্থ্য বিভাগের তদন্ত দল
মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকের পিস্তলটি অবৈধ: পুলিশ
কেআই