মানুষের ভালবাসায় আবার আকাশে উড়বে ঈগলটি
রুমন চক্রবর্তী, কিশোরগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
রীতিমতো হইচই ব্যাপার! যারা শুনছেন, তারাই এক নজর ঈগলটি দেখতে ভিড় করছেন। প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের চিকিৎসকরাও মাঝেমধ্যে খোঁজ নিচ্ছেন ঈগলের শরীর স্বাস্থ্যের। কেউ কেউ আবার পাখির জন্য নিয়ে আসছে মাছ। ছবিও তোলা হচ্ছে ওর সঙ্গে। এতে বেশ বিরক্ত হচ্ছে পাখিটি। তবে তরুণদের উদ্যোগ প্রশংসা পাছে লোকজনের কাছে। তারা বলছেন, পশুপাখির প্রতি মানুষের এই মমতা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
পাখি নিয়ে এই মাতামাতির ঘটনা কিশোরগঞ্জ শহরের বত্রিশ এলাকার। সপ্তাহ দুয়েক আগে আহত একটি ঈগল উদ্ধার করেন কয়েকজন তরুণ। তারাই এখন এর সেবা-শুশ্রুষা করছেন। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া ও নিরাপত্তার সব দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
সরকারি চাকুরে বত্রিশ এলাকার বাসিন্দা মো. ফেরদৌস আজিজ রাইজিংবিডিকে জানালেন, প্রায় দু-সপ্তাহ আগে শিকার ধরতে গিয়ে মারাত্মক আহত হয় ঈগলটি। শত চেষ্টা করেও আর উড়তে পারছিল না। উড়তে অক্ষম আহত ঈগলটি উদ্ধার করে কয়েকজন তরুণ নিয়ে যান প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসক তাঁদের জানিয়েছেন, পাখিটি সুস্থ হতে বছরখানেক সময় লাগবে। এরপর থেকে ঈগলের দেখাশোনা ও সেবাযত্ন তাঁরাই করছেন।
ওই তরুণদের একজন সৈকত সরকার। তাঁর ওষুধের ব্যবসা রয়েছে। পাখিটির উদ্ধার তৎপরতা ও এর খাদ্য দেওয়া সম্পর্কে তিনি জানান, বত্রিশ এলাকায় প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের আশপাশেই থাকত ঈগলটি। বয়স বেড়ে যাওয়ায়, খুববেশি ওড়াউড়ি করত না। সহজ শিকারগুলোই কেবল ধরে ধরে খেত। তবে কয়েকদিন আগে শিকার ধরতে গিয়ে গুরুতর আহত হয় পাখিটি। শিকার তাড়া করে হাসপাতালের দেয়ালে ধাক্কা লেগে পড়ে যায় মাটিতে। ডানা ঝাপটে এপাশ ওপাশ করলেও আর উড়তে পারেনি। দৃশ্যটি ধরা পড়ে তাঁদের চোখে। তাঁরাই ধরাধরি করে ঈগলটিকে নিয়ে যান প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে। এরপর থেকে তাদের মায়ায়, আতিথ্যে চলছে ঈগলের চিকিৎসা।
আপাতত প্রাণিসম্পদ হাসপাতাল চত্বরে হয়েছে ঈগলটির আবাসন ব্যবস্থা। তাকে সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করেন দুজন নৈশপ্রহরী। একজন সেবাযত্নের দায়িত্বে, আরেকজন নিশ্চিত করেন পাখিটির নিরাপত্তা। আর ওই তরুণদের কাজ হলো ঈগলের চিকিৎসা ও খাবার খরচ জোগানো। তারা বলছেন, ঈগলের জন্য প্রতিদিন খরচ হয় অন্তত ২০০ টাকা। তাই বাধ্য হয়ে এলাকায় চাঁদা তুলতে হচ্ছে তাদের। যত দিন লাগে পাখিটির দেখাশোনা করবেন তাঁরা। তারা চায়, এটি সুস্থ হয়ে আবার উড়ে যাক আকাশে।
স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের নৈশপ্রহরী ওমর ফারুক বলেন, ‘পাখিটিকে আমরা মুক্তভাবে রেখেছি। এটি নিজের মতো করে হাঁটাচলা করছে।’ চিকিৎসকের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘বয়স বেড়ে যাওয়ায় ঈগলের পালকগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। চিকিৎসা ও খাবার পেলে, পুরনো পালকগুলো ঝরে যাবে এবং নতুন পালক গজাবে। পরে আবার উড়তে পারবে পাখিটি। এই প্রক্রিয়া শেষ হতে বছরখানেক লাগবে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যত দিন লাগুক-আমরা পাখিটিকে সুস্থ করে তুলব।’
প্রাণিসম্পদ হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে ঈগলটির বয়স। বয়স বেড়ে যাওয়ায় দুর্বল হয়ে গেছে পাখিটি। তাই প্রয়োজনীয় শিকারও ধরতে পারছিল না সে। তবে দীর্ঘ চিকিৎসা ও খাবারদাবার পেলে আবার সুস্থতা ফিরে পাবে ঈগলটি। একই সঙ্গে গজাবে নতুন পালক। তখন নতুন শক্তিতে আবার উড়তে পারবে আকাশে।
কিশোরগঞ্জ জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতালের ভেটেরিনারি অফিসার ডা. মো. সাইফুল ইসলাম পাখিটির চিকিৎসা করছেন। তিনি বলেন, ঈগল একটি শিকারি পাখি। বয়স বেড়ে গেলে একসময় এটি আর উড়তে পারে না। তখন সে বেঁচে থাকার জন্য লোকালয়ে থাকার চেষ্টা করে। যেখানে সহজে খাবার পাওয়া যায়। এ পাখিটি তেমন কোনো রোগে আক্রান্ত না। বয়সের কারণে দুর্বল হয়ে গেছে। বছর খানেকের পরিচর্যা ও চিকিৎসা পেলে আবার উড়তে পারবে। তবে পাখিটির প্রতি স্থানীয় তরুণের অনুরাগ ও ভালোবাসা দেখে ভালো লেগেছে। প্রতিটি প্রাণীর প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতা থাকলে জীব-বৈচিত্র্য উপকৃত হবে। মানুষও ভালো থাকবে।
/বকুল/