ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

নীহার বানু হত্যা মামলায় আলোচনায় আসেন টিপু

শিরিন সুলতানা কেয়া, রাজশাহী  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩১, ১৮ মার্চ ২০২৪  
নীহার বানু হত্যা মামলায় আলোচনায় আসেন টিপু

গোলাম আরিফ টিপু

গ্রামের নাম কমলাকান্তপুর। সাক্ষী হিসেবে এজলাসে দাঁড়িয়ে উকিলকেই নাজেহাল করা বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত এ গ্রামে জন্ম নেননি। তবে এ গ্রামে জন্ম নিয়েছেন সাক্ষীদের পেটের কথা মুখে বের করে আনা এক জাঁদরেল উকিল। তিনি সত্তরের দশকে সারাদেশে আলোচিত নীহার বানু হত্যা মামলায় লড়েছেন। ওয়ান ইলেভেনে শেখ হাসিনার মামলায় যুক্তিতর্ক করেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। 

প্রথিতযশা এই আইনজীবী গোলাম আরিফ টিপু। ১৯৩১ সালের ২৮ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের মালদহ জেলার কমলাকান্তপুর গ্রামে জন্ম। দেশভাগের পর গ্রামটি পড়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায়। ৯৩ বছর বয়সে গত শুক্রবার (১৫ মার্চ) সকালে রাজধানী ঢাকায় মারা যান তিনি। শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শনিবার (১৬ মার্চ) তাঁর মরদেহ গ্রামের বাড়ি ও রাজশাহী কলেজে নেওয়া হয়। সন্ধ্যায় রাজধানীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। 

গোলাম আরিফের বেড়ে ওঠা 
গোলাম আরিফ টিপুর বাবা আফতাব উদ্দিন আহমদ ছিলেন জেলা রেজিস্ট্রার। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে টিপু দ্বিতীয়। তিনি প্রাথমিকের শিক্ষা নিয়েছেন গ্রামের স্কুলে। এরপর ১৯৪৮ সালে কালিয়াচর বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। ১৯৫০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বামপন্থি আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে বহিষ্কৃত হয়ে আবারও রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন আইন বিষয়ে। এখানে স্নাতক শেষ করে আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। এরপর রাজশাহী ফিরে এসে আইন পেশায় মনোনিবেশ করেন। সারা জীবন তিনি লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন।

আন্দোলন-সংগ্রামে
রাজশাহী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন গোলাম আরিফ টিপু। আনারুল হক আনার ‘রাজশাহীর কথা’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘১৯৪৮ সালে রাজশাহী কলেজে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন আতাউর রহমান, মুহম্মদ একরামুল হক ও আবুল কাশেম চৌধুরী। তাঁরা গ্রেপ্তার হলে নেতৃত্বশূন্য অবস্থার সৃষ্টি হয়। হাবিবুর রহমান শেলী ও মুহম্মদ সুলতানও ১৯৪৯ সালে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় চলে যান। তখন আন্দোলনের হাল ধরেন এস এ বারী, গোলাম আরিফ টিপুসহ কয়েকজন। তাঁদের নেতৃত্বে আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। রাজশাহীতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে গোলাম আরিফ টিপু ছিলেন এর সদস্য। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে হরতাল পালিত হচ্ছিল। বিকালে ভুবনমোহন পার্কে চলছিল জনসভা। তখনই ঢাকায় কয়েকজন ভাষাসৈনিক শহীদ হওয়ার খবর আসে।

‘এই শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধায় আন্দোলনরত ছাত্ররা রাজশাহী কলেজের নিউ হোস্টেলে ‘শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। গোলাম আরিফ টিপুসহ অন্য ছাত্ররা ওই রাতে ইট আর কাদামাটি দিয়ে স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি করেন। স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের আগে হোস্টেল প্রাঙ্গণে এসএমএ গাফফারকে সভাপতি আর হাবিবুর রহমান ও গোলাম আরিফ টিপুকে যুগ্ম সম্পাদক করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পুলিশ পর দিন সকালে স্মৃতি স্তম্ভটি গুড়িয়ে দেয়। তারপরও আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পরবর্তীতে গোলাম আরিফ টিপু উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে যোগ দেন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও কাজ করেন। তিনি ছিলেন ভাতাভোগী বীর মুক্তিযোদ্ধা।’ 

ছাত্রজীবনে গোলাম আরিফ টিপু বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। ১৯৫৩ সালে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনকে সভাপতি ও গোলাম আরিফ টিপুকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি হয়। রাজশাহী ফেরার পর মস্কোপন্থি ন্যাপের জেলার সভাপতি হন।ৎ

ন্যাপের জেলা সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান খান আলম বলেন, ছাত্রজীবন থেকে টিপু ভাই প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। তিনি ভালো ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। সে সময় একটা কথা ছিল, টিপুর পায়ে বল মানেই গোল। তিনি টাউন ক্লাবের মালিকদেরও একজন ছিলেন। 

ভাষা সৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি বলেন, গোলাম আরিফ টিপু ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইংরেজিতে কথা বলতে পারতেন। তারপরও বাংলার জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন। বাংলা ভাষার জন্য রাজশাহীতে যত কর্মসূচি ছিল, তার প্রতিটিতেই গোলাম আরিফ টিপুর বিশেষ অবদান ছিল। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলনেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। 

যশ নীহার বানু হত্যা মামলায়
রাজশাহী ফিরে গোলাম আরিফ টিপু আদালতে ওকালতি শুরু করেন। আর পাঁচজন আইনজীবীর মতোই সবকিছু চলছিল। ১৯৭৬ সালে খুন হওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নীহার বানু হত্যা মামলায় বিবাদীপক্ষের ডিফেন্স আইনজীবী হিসেবে তাঁর যশ ছড়িয়ে পড়ে। বগুড়ায় সামরিক আদালতে ১৯৭৭ সালে বহুল আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা হয়। এরপর এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনী প্রকাশ করে সাপ্তাহিক বিচিত্রা। এটি লিখেছিলেন তৎকালীন দৈনিক বাংলার রাজশাহী প্রতিনিধি আহমেদ সফিউদ্দিন। নীহার বানুকে হত্যার ঘটনায় তিনিই প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। শনিবার (১৬ মার্চ) রাজশাহী কলেজে গোলাম আরিফ টিপুর জানাজায় অংশ নিতে আসেন প্রবীণ এই সাংবাদিক।

প্রবীণ সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, ‘গোলাম আরিফ টিপু আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সাহসী, বিপ্লবী এবং গণমানুষের বন্ধু। তিনি স্কুল জীবন থেকে তেভাগা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তাঁর শিক্ষক ছিলেন ইলামিত্রের স্বামী রমেন মিত্র। তাঁর কাছে দীক্ষা নেন তিনি। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জন্য বিনাপয়সায় আদালতে লড়াই করতেন তিনি। নীহার বানু হত্যা মামলা নিয়ে আমি যেসব রিপোর্ট করতাম, তখনই তিনি আলোচনায় আসেন। অনেক ঝুঁকি নিয়েও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তিনি লড়াই করেছেন।’

নীহার বানু হত্যা মামলার পর সারা দেশে অসংখ্য মামলায় তিনি ডিফেন্স কৌঁসুলি হিসেবে নাম করেন। ব্যস্ততার কারণে ১৯৯১ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবির হত্যা মামলায় ১৬০ ছাত্রনেতার হয়ে লড়ে তাঁদের খালাস করান। অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও গরিব মানুষের মামলা তিনি বিনাপয়সায় করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্ষোভে আটক শিক্ষক-ছাত্রদের হয়েও আইনি লড়াই করেছেন।

দেশের প্রথিতযশা এই আইনজীবী মেজর জেনারেল মঞ্জু হত্যা মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। তিনি একাধিকবার রাজশাহী বার সমিতির সভাপতি হন। ওয়ান ইলেভেনের সময় তিনি ঢাকায় পাড়ি দেন এবং সে সময় কারাবন্দি থাকা আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিফেন্স কৌঁসুলি হিসেবে আদালতে আইনি লড়াই চালান। তাঁর যুক্তিতর্ক সবাইকে মুগ্ধ করে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে ২০১০ সালে তাঁকে চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন।

আক্ষেপ ছিল না
ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদান রাখায় ভাষা সংগ্রামী হিসেবে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার গোলাম আরিফ টিপুকে একুশে পদকে ভূষিত করে। তখন এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যে অবদানের জন্য তাঁকে একুশে পদক দেওয়া হলো, তা তিনি আরও আগেই পেতেন। তারপরও তিনি খুশি। তাঁর এই খুশি বিষাদে ঢেকে যায় ওই বছরের ডিসেম্বরে। তখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও ভাতাভোগী এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম। 

পরে এক সংবাদ সম্মেলনে গোলাম আরিফ টিপু বলেন, তালিকায় নিজের নাম দেখে তিনি হতবাক, বিস্মিত, মর্মাহত ও অপমাণিত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সীমাহীন অযত্ন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে অত্যন্ত অবহেলার সঙ্গে এই তালিকা প্রকাশ করেছে। সমালোচনার মুখে তখন ওই তালিকা স্থগিত ঘোষণা করে ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেয় মন্ত্রণালয়।

গত শনিবার রাজশাহী কলেজে গোলাম আরিফের মেয়ে ডানা নাজলী বলেন, ‘আমার বাবার কোনো চাওয়া ছিল না। তিনি জীবনে যা পেয়েছেন, তাই নিয়ে খুশি ছিলেন। তিনি জীবনে সব কিছুই পেয়েছেন, এটা বলতেন। কোনো আক্ষেপ ছিল না। বাবার যে আদর্শ সেটা নিয়ে আমরা সারা জীবন বাঁচব। সৎ থেকে মানুষের কল্যাণে যা যা করা যায়, তিনি তার সবই করতেন। আমরা চেষ্টা করি, অন্যায় কিছু না করার। বাবার মতো সৎ পথে থাকার।’
 

/বকুল/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়