ঢাকা     রোববার   ০৭ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২৩ ১৪৩১

স্বাধীনতা পদকে মনোনীত হওয়ায় উচ্ছ্বসিত ময়মনসিংহের তিন বিশিষ্টজন

মাহমুদুল হাসান মিলন, ময়মনসিংহ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৬, ১৮ মার্চ ২০২৪  
স্বাধীনতা পদকে মনোনীত হওয়ায় উচ্ছ্বসিত ময়মনসিংহের তিন বিশিষ্টজন

ডা. হরিশংকর দাশ, ফিরোজা খাতুন এবং অরন্য চিরান

বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে অসামান্য অবদানের জন্য ১০জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদক-২০২৪’ এর জন্য মনোনীত হয়েছেন। গত শুক্রবার প্রকাশিত ওই তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন ময়মনসিংহের তিন বিশিষ্টজন। তারা হলেন- চিকিৎসাবিদ্যায় ডা. হরিশংকর দাশ, সমাজসেবায় অরন্য চিরান, ক্রীড়ায় ফিরোজা খাতুন। এক জেলা থেকে তিন জন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদক পাওয়ায় স্থানীয়রা খুশি। পুরস্কারের জন্য মনোনীতরা জানিয়েছেন, তারা বিশ্বাসই করতে পারেননি পদক পাবেন। আগামীতে মানুষের জন্য আরও কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন এই তিন গুণী ব্যক্তিত্ব।

চিকিৎসাবিদ্যায় পুরস্কার পাওয়া ডা. হরিশংকর দাশ ময়মনসিংহ নগরের চরপাড়াস্থ পারমিতা চক্ষু হাসপাতালের সত্ত্বাধিকারী। গতকাল রোববার (১৭ মার্চ) দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিকভাবেই রোগী দেখছেন এই চিকিৎসক। প্রতিদিন বিনামূল্যে একঘণ্টা রোগী দেখেন তিনি। এছাড়াও, অন্য সময় তিনি সামার্থহীনদের বিনামূল্যে বা অর্ধমূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। 

চক্ষু চিকিৎসক ডা. হরিশংকর দাস মনে করেন- বাংলাদেশে যারা মানুষের কল্যাণে কাজ করেন তাদের মূল্যায়ন হয়, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। তিনি বলেন, ‘যখন ফোন করে আমাকে জানানো হলো আমি স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছি তখন বিশ্বাস হয়নি। পরে পরিচিত একজনকে ফোন করে বিষয়টি নিশ্চিত হই। টানা তিন বছর ধরে আবেদন করার পর এবার সরকার আমাকে মনোনীত করেছে। এই অর্জন ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষকে উৎসর্গ করতে চাই।

প্রতিক্রিয়ায় ডা. হরিশংকর বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলাম। এরপর থেকে আমি মানুষের সেবায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমি বিনা পয়সায় অনেক রোগীর অপারেশন করে দিয়েছি। অনেক গরিব রোগী, যারা ওষুধ কিনতে পারেন না, তাদের আমি ফ্রি ওষুধও দিয়ে থাকি। কোনো রোগী যেন বিনা চিকিৎসায় ফেরত না যায়- এটাই আমার মূল লক্ষ্য। এভাবেই আমি চলছি, আজীবন নিজেকে রোগীর সেবায় নিয়োজিত রাখতে চাই। 

জীবনের শেষ বয়সে আসা ক্যানসারে আক্রান্ত এই চিকিৎসক বলেন, আমি মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রোগী দেখতে চাই। স্বাধীনতা পদকে মনোনীত হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করা এই চক্ষু চিকিৎসক বলেন, এর আগেও আমি দেশি ও আন্তর্জাতিক অনেক পুরস্কার পেয়েছি। তবে এবারেরটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার। স্বাভাবিকভাবেই আমি উচ্ছ্বসিত আনন্দিত। 

ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কারে মনোনীত হয়েছেন ময়মনসিংহ নগরীর বুড়াপিড়ের মাজার এলাকার বাসিন্দা ফিরোজা খাতুন। তিনি তার প্রয়াত বাবা আমির উল হকের প্রেরণায় ক্রীড়ায় মনোনিবেশ করেছিলেন। নগরীর রাধাসুন্দরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এই ছাত্রী স্কুল জীবন থেকেই খেলাধুলা শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে হাই জাম্প দিয়ে ক্রীড়া জগতে পা রাখেন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১০ বার ১০০ মিটার দৌঁড়ে দ্রুততম মানবী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন তিনি। বিয়ের পর ২০ বছর খেলার বাইরে থাকলেও শেষ বয়সে এসে ফের ক্রীড়ায় মনোনিবেশ করেছেন তিনি। ময়মনসিংহ বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও স্কেটিং একাডেমির সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছেন। ফিরোজা খাতুন এখন জয়নুল আবেদিন উদ্যান এলাকায় শিশুদের স্কেটিং শেখান।

ফিরোজা খাতুন বলেন, যখন আমাকে ফোন করে বলা হলো আমি মনোনীত হয়েছি, তখন বিশ্বাসই করতে পারিনি। পরে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে যাচাই করি। সেই সময় আমার কান্না চলে এসেছিল। প্রথমবার আবেদন করেই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবো ভাবতে পারিনি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পদক স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়ে গেলাম। 

তিনি আরও বলেন, মনে একটা ধারণা ছিল, এবার হয়তো পুরস্কারটি নাও আসতে পারে। পরেরবার আবারও আবেদন করব, তখন হয়তো পেয়ে যাব। এবারই যে পেয়ে যাব, তা আমার চিন্তায় ছিল না। জাতীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ফিরোজা করিম নেলি আপা আমাকে জোর করে আবেদন করিয়েছেন। তিনি আমার কাগজপত্র সবকিছু ঠিক করে দিয়েছেন। তার কথাতেই আমি আবেদন করেছি। তিনি (ফিরোজা করিম নেলি) না বললে আমি আবেদন করতাম না, আর পুরস্কারও পেতাম না।

পুরস্কার বাবাকে উৎসর্গ করতে চান জানিয়ে ফিরোজা খাতুন বলেন, এর আগেও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কার নিয়েছি। এবারও পুরস্কার নেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রীকে কিছু একটা বলব।  খেলাধুলায় নারীদের আগে অনেক অন্তরায় ছিলো। তবুও বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে এসেছি, তবে এখন পরিবেশ অনেকটা ভালো। বাংলাদেশের দ্বিতীয় নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছি এ বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আপ্লুত করছে। আগামীতে কেউ আমাকে কাজে লাগাতে চাইলে এ প্রজন্মের জন্য কাজ করতে চাই। 

সমাজসেবায় অবদানের জন্য অরন্য চিরান পাচ্ছেন স্বাধীনতা পুরস্কার। তিনি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের দিঘলবাগ গ্রামের মৃত ক্ষিতীশ মানখিনের ছয় ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড়। ১৯৮০ সালে জন্ম নেওয়া অরন্য চিরান একটি এনজিওতে প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেন ২০১১ সাল থেকে। চাকরির পাশাপাশি তিনি ছাত্রজীবন থেকে সামাজসেবামূলক কাজ শুরু করেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তাদেরকে স্কুলমুখী করেছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করে শিক্ষা উপকরণ দিয়ে ঝরে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগণের জন্য কাজ করেছেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টাঙ্গাইলের মধুপুর ও ধোবাউড়ায় শিক্ষা বিস্তারে কাজ করেন অরন্য চিরান। সেই সময়ে তিনি নিজেও শিক্ষকতা করেন।

প্রথমবার আবেদন করেই স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত হওয়া অরন্য চিরানকে নিয়ে স্থানীয়ভাবে মতানৈক্য তৈরি হলেও তিনি বলেন, আমাকে সবাই চিনবে বিষয়টি এমন নয়। আমি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। সরকারের সঙ্গে তৃণমূল মানুষ ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সেতু বন্ধনের কাজ করছি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ভূমি, পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করতে কাজ করেছি। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পুণরায় শিক্ষায় ফেরানো, পথশিশু, হরিজনদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে ও জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছি। বিভিন্ন মানুষের চিকিৎসায় সহায়তা করেছি। এভাবেই বাকি জীবন কাজ করে যেতে চাই।

মাসুদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়