লক্ষ্মীপুরে লবণাক্ত বেড়ে মরে যাচ্ছে সয়াবিন গাছ
জাহাঙ্গীর লিটন, লক্ষ্মীপুর || রাইজিংবিডি.কম
লক্ষ্মীপুরকে বলা হয় সয়াল্যান্ড জেলা। রবি মৌসুমে উপকূলীয় এ জেলার চরাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে সয়াবিনের আবাদ হয়। ফলনও ভালো হয়। সয়াবিনের পাশাপাশি বোরো ধান এবং সবজির আবাদ করে কৃষকেরা।
তবে এবার ব্যতিক্রম চিত্র দেখা গেছে, সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নে। ইউনিয়নের দুটি ওয়ার্ডের মৌলভীরহাট, বয়ার চর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকায় ফসলি জমি অনাবাদি পড়ে আছে। মাটিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় গত ১০ বছর ধরে অন্তত তিন শতাধিক একর জমিতে রবি মৌসুমে শষ্য আবাদ হয় না। তবে কিছু কিছু জমিতে সয়াবিনের আবাদ করলে মরে যাচ্ছে কচি গাছ। এতে লোকসানে পড়েছে কৃষকরা। আবাদে নিরুৎসাহিত হচ্ছে তারা।
এদিকে, ফসল উৎপাদন না হওযায় জমির মাটি যাচ্ছে ইটভাটায়। ফসল না হওয়ার পেছনে লবণাক্ততার পাশাপাশি ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও তাপকেও দূষছেন স্থানীয়রা। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে যেখানে চাষাবাদের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। সেখানে বিস্তৃীর্ণ জমি থেকে যাচ্ছে ফসল উৎপাদনের বাইরে। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের নজরদারির অভাবকেই দায়ী করছেন কৃষকরা।
সরেজমিন দেখা যায়, ১৯নং তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের ৮ এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিস্তৃীর্ণ জমি খাল পড়ে আছে। ওইসব জমির মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে পাশের ইটভাটায়। সামান্য কিছু জমিতে সয়াবিন চাষাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষেতে চারা গজানোর হার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের মতো। আবার ক্ষেতের কচি চারাগুলো হলুদ বর্ণ ধারণ করে মরে যাচ্ছে। ক্ষেতের আইল বা অনাবাদি জমির বিভিন্ন স্থানে সাদা সাদা লবণের দাগ দেখা গেছে।
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, ১০ বছর আগেও এসব জমিতে রবি মৌসুমে সয়াবিনের আবাদ হতো। তখন জমিতে লবণের পরিমাণ কম ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে লবণের তীব্রতা বেড়েছে। তাই রবি মৌসুমে এখন আর এখানে ফসল হয় না। বেশিরভাগ কৃষক তাদের জমি খালি রাখেন। যারা বীজ বপন করেন, শেষ পর্যন্ত ফলনও তুলতে পারেন না। তবে আমন মৌসুমে এ এলাকায় ধান চাষ কিছুটা ভালো হয় বলে কৃষকরা জানিয়েছেন।
শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ত জমিতে পানির সরবাহ নিশ্চিত করা গেলে কৃষি উৎপাদন নিশ্চিত করা যাবে বলে জানিয়েছে স্থানীয় লোকজন, কৃষক ও কৃষি বিভাগ।
তেওয়ারীগঞ্জের ৯ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জাফর আহম্মদ জমি চাষাবাদ করেন। তিনি চলতি মৌসুমে ২ একর জমিতে সয়াবিনের বীজ বুনেছেন৷ বীজ থেকে চারা গজালেও একটু বড় হওয়ার পর কচি চারাগুলো মারা যাচ্ছে।
এ জনপ্রতিনিধি বলেন, হালচাষসহ বীজ বপনে ৩০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। কিন্তু ক্ষেতের চারাগুলো ঝলসে গেছে। তাই ক্ষেতে সয়াবিনের ফলন না হওয়ার আশঙ্কায় আছেন।
স্থানীয় কৃষক সিরাজুল হক বলেন, ‘৪০ শতাংশ জমিতে সয়াবিন চাষাবাদ করেছি। অর্ধেক জমির চারা গজিয়েছে। চারাগুলো এখন হলুদ বর্ণ ধারণ করে মরে যাচ্ছে। তবে কিছু কিছু জমিতে আমন ধানের চাষাবাদ ভালো হয়েছে। কিন্তু অনেক জমির মাটি কেটে নিচু করা হয়েছে। তাই আমনের মাঝামাঝিতে উপরের জমিগুলো পানি থাকে না৷ তখন ওইসব জমির আমন ধানও ভালো হয় না।’
চরের কৃষক আবু তাহের, জিল্লাল মুন্সী, বাদশা মিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, এ এলাকায় জমিগুলো লবণাক্ত। ফলে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ করা যায় না৷ তবে যখন পানি থাকে, তখন ধান চাষ করা যায়। একদিকে জমিতে লবণ, অন্যদিকে একটি এলাকায় ৮ থেকে ১০টি ইটভাটা রয়েছে। এ দুই কারণে এ এলাকায় কৃষিতে বিপর্যয় ঘটেছে। তিনশত একরের বেশি জমি এ অবস্থায় পড়ে আছে বলে জানান তিনি।
তারা আরও বলেন, জমিতে লবণের কারণে ফসল হয় না। এ সুযোগটা ইটভাটার মালিকেরা কাজে লাগাচ্ছে। তারা মাটি কিনে নিচ্ছে। অনাবাদি জমির মাটি ইটভাটায় যাচ্ছে। এসব বিরুদ্ধে প্রশাসনের কার্যকর প্রদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
স্থানীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বলেন, শুষ্ক মৌসুমে জমিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যায়। ওই এলাকায় অনেকগুলো ইটভাটা রয়েছে। ফলে ভাটা থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ড্রাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। বিষাক্ত এ গ্যাসগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। কুয়াশা বা হালকা বৃষ্টির সঙ্গে এ গ্যাসগুলো এ্যাসিডে পরিণত হয়। এ্যাসিড বৃষ্টির ফলে ওই এলাকার ফসলি মাঠের ফসলসহ গাছপালার মারাত্মক ক্ষতি হয়।
তিনি আরও বলেন, লবণাক্ত জমিতে নিয়মিত পানি রাখা গেলে রবি মৌসুমে বোরো ধানের চাষাবাদ করা যেত। তেওয়ারীগঞ্জের পাশের তোরাবগঞ্জ বাজার পর্যন্ত মুসারখালে পানি থাকে। কিন্তু এ খাল থেকে তেওয়ারীগঞ্জের দিকে যে সংযোগ খালটি আছে, সেটি সংস্কার অভাবে ভরাট হয়ে আছে। কিছু কিছু জায়গায় দখল হয়ে গেছে। খালটি পুনঃখননের উদ্যোগ নিয়ে পানি সেচের ব্যবস্থা করলে বোরো চাষাবাদের আওতায় আনা যেত। কৃষি জমির মাটিও ইটভাটায় বিক্রি হতো না। কিন্তু এসব বিষয়ে কৃষি বিভাগসহ প্রশাসনের নজরদারি নেই। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান এই স্কুল শিক্ষক।
ওই এলাকার দায়িত্বরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. রাকিব হোসেন বলেন, জমিতে লবণের পরিমাণ বেশি। ফলে কোনো ফসল হয় না। এ জন্য কৃষকেরা জমি খালি রেখে দেয়। কিছু কিছু জমিতে সয়াবিনের আবাদ হলেও সেগুলো অবস্থাও ভালো না। কৃষকরাও তেমন সচেতন না। তারা পুরনো জাতের সোহাগ জাতের সয়াবিন চাষাবাদ করে। যা লবণসহিষ্ণু নয়। লবণসহিষ্ণু কিছু জাত আছে, সেগুলো আবাদ করলে কিছুটা ভালো ফলন হতো।
তিনি বলেন, লবণাক্ত জমিতে জৈব সারের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম সালফেট প্রয়োগ করলে লবণের মাত্রা কিছুটা কমে।
সেচ সরবরাহের বিষয়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. রাকিব হোসেন বলেন, একটি খাল আছে, সেটি বিভিন্ন স্থানে দখল হয়ে আছে। এটি সংস্কার করে পানি আনার ব্যবস্থা করলে অনাবাদি এসব জমি বোরো চাষাবাদে আওতায় আসতো। জমিতে নিয়মিত পানি থাকলে লবণের তীব্রতা কমে যায়। ফসলও হয়। কিন্তু খাল খনন বা সেচের বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) দেখে থাকেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক ড. মো. জাকির হোসেন রাইজিংবিডিকে জানান, মাটির তলদেশে লবণাক্ত পানি থাকলে শুষ্ক মৌসুমে তাপমাত্রা বেশি হলে জমিতে লবণের মাত্রা বেড়ে যায়। তবে জমিতে যখন পানি থাকে বা জমি ভেজা থাকে, তখন লবণের মাত্রা কম থাকে। লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদ কম হয়। তবে কিছু কৌশল অবলম্বন করলে চাষাবাদ করা যায়। আমন ধান কাটার আগেই বিনাচাষে জমিতে সয়াবিন বীজ বপন করে দিতে পারে। তখন জমি শুকানোর আগেই সয়াবিন গাছ বড় হয়ে যাবে। গাছের পাতা গজালে সরাসরি মাটিতে রোধের আলো কম পড়বে। এতে লবণের তীব্রতা কম দেখা দেবে।
লবণের জমিতে বেশি পরিমাণে ভার্মি কম্পোস্ট বা জৈব সার ব্যবহার করার পরামর্শ এ কৃষি কর্মকর্তার।
/বকুল/