আনন্দে ভাসছে দেউন্দির চা বাগান
মো. মামুন চৌধুরী, হবিগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

বাবা-মায়ের সাথে মেধাবী শিক্ষার্থী জনি ভৌমিক
চা শ্রমিকের সন্তান জনি ভৌমিক এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার এ সাফল্যে চা বাগানজুড়ে আনন্দ বইছে।
আনন্দ হওয়ারই কথা, এবার বাগান এলাকায় এমন রেজাল্ট আর কেউ করতে পারেনি। জনি উপজেলার দেউন্দির ফাঁড়ি চা বাগান গেলানীয়ার বাসিন্দা। জনি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার অগ্রণী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে এ সাফল্য অর্জন করেছে।
বাগান পঞ্চায়েত সভাপতি অমল ভৌমিক ও মা অবলা ভৌমিক দম্পতির ২য় সন্তান জনি। তার বাবা-মা চা বাগানের শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
সরেজমিন কথা হয় জনি ভৌমিকের সঙ্গে। জনি জানায়, গেলানীয়া সরকারি প্রাইমারি থেকে ৫ম শ্রেণি পাস করে বাগানের পাশে বদরগাজী কেজি অ্যান্ড হাইস্কুলে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে সে। পরে ভর্তি হয় বাগান থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরের আমতলী এলাকার অগ্রণী উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে চান্দপুর গিয়ে বাইসাইকেল রেখে ৫ টাকা ভাড়ায় ব্যাটারিচালিত টমটমে করে স্কুলে যেতো। নিয়মিত স্কুলে গিয়ে ক্লাস করতো। ফলে ভালো রেজাল্ট এসেছে তার।
জনি জানায়, বাবা-মাকে বাগানে শ্রমিকের কাজ করে পরিবারের আহার জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাদের (বাবা-মা) পক্ষে জনিদের তিন ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ চালানো কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিলো না। অবশেষে বাবা সিদ্ধান্ত নিয়ে গরু পালনের সাথে কৃষি কাজে যুক্ত হন। বাগানের কাজ শেষে গরু ও কৃষি কাজ করে অর্থ উপার্জন করছেন। এ অর্থে আমরা তিন ভাই লেখাপড়া করতে পারছি। এখানে বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ স্কুলের শিক্ষকদের প্রতিও।
দৈনিক ৮ থেকে ১৩ ঘণ্টা লেখাপড়া করতো জনি। এভাবেই সাফল্য মিলেছে তার। লেখাপড়া করে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে তার। তাই সবার কাছে আশির্বাদ চেয়েছে জনি।
বাবা অমল ভৌমিক বলেন, আমার কোনো ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট নাই। সন্তানরাই আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। নিজের শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ তিন সন্তানের পড়ালেখার পিছনে ব্যয় করছি। আমি বাগানের শ্রমিক। কঠোর শ্রমের মাধ্যমে রোজগার করতে হয়। এখানে আমার সন্তানরা যেন শ্রমিক না হয়ে বড় চাকরিজীবী হয়।
তিনি বলেন, বড় ছেলে জীবন ভৌমিক সিলেট লিডিং ইউনিভার্সিটিতে ও ছোট ছেলে রনি ভৌমিক বদরগাজী পপুলার কেজি অ্যান্ড হাইস্কুলে পড়াশোনা করছে। জনি আমার মেজ সন্তান। আমার বিশ্বাস সন্তানরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে বহুদূর এগিয়ে যাবে। আমাদের মুখ আরও উজ্জল করবে।
মা অবলা ভৌমিক বলেন, ছেলে জনিকে সাহস উৎসাহ দিয়েছি। বলেছি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে। ভালো রেজাল্ট আসবে। সত্যি হয়েছে। ছেলে আমাদের মুখ উজ্জল করেছে। তাকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। সন্তানদের অভাব বুঝতে দেইনি।
দেউন্দি চা বাগানের প্রতীক থিয়েটার সভাপতি ডা. সুনীল বিশ্বাস বলেন, নাটক গানের মাধ্যমে অবহেলিত চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু এখনও চা শ্রমিকদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তারপরও লস্করপুর ভ্যালির মধ্যে চা শ্রমিকের সন্তান জনি ভৌমিক থেমে থাকেনি। সে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে। সে বাগানবাসীকে সম্মানিত করেছে। প্রতীকের পক্ষ থেকে তার জন্য শুভকামনা।
পাইকপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়াহেদ আলী মাস্টার বলেন, চা শ্রমিকদের সন্তানরা স্কুল কলেজ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। তারা এগিয়ে যাচ্ছে। গেলানীয়া চা বাগানের বাসিন্দা জনি এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার জন্য শুভকামনা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আয়েশা আক্তার বলেন, নিয়মিত স্কুলে যেতে হবে। করতে হবে ক্লাস। পড়াশুনায় মনোযোগী হলে ভালো রেজাল্ট সম্ভব। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে তার প্রমাণ দেখালো গেলানীয়া চা বাগানের শ্রমিক অমল ভৌমিকের সন্তান জনি ভৌমিক।
তিনি বলেন, বাগানের শ্রমিকদের সন্তানদের স্কুলমুখী করতে উপজেলা প্রশাসন নানাভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এরফলে সফলতা আসতে শুরু করেছে। সময়ের সাথে চা শ্রমিকের সন্তানরা লেখাপড়া করে আরও এগিয়ে যাবে।
/টিপু/