ঢাকা     রোববার   ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২৮ ১৪৩১

মৎস্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জেলেকে হত্যার অভিযোগ, ভয়ে মাছ শিকার বন্ধ

বরগুনা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৪, ১৭ মে ২০২৪   আপডেট: ১৮:৪৩, ১৭ মে ২০২৪
মৎস্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জেলেকে হত্যার অভিযোগ, ভয়ে মাছ শিকার বন্ধ

মারা যাওয়া জেলে রিপনের পরিবার

অবৈধ জাল উদ্ধারে অভিযানে গিয়ে রিপন (৪১) নামে এক জেলেকে মারধর করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়েছেন বলেও স্থানীয় জেলেরা অভিযোগ করেছেন। 

এ দিকে ঘটনার পর ভুক্তভোগীরা অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণে মামলা করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন। তাদের অনেকে নির্যাতন আতঙ্কে নদীতে মাছ ধরতে যাচ্ছেন না বলেও জানান। 

বরগুনার পাথরঘাটার দক্ষিণ কুপধন এলাকার সুলতান হাওলাদারের ছেলে দেলোয়ার হোসেন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, গত ২৫ এপ্রিল রাত আড়াইটার দিকে বিষখালী নদীতে জাল ফেলে বাড়ি ফিরছিলাম। এমন সময় বরগুনা সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এসএম মাহমুদুল হাসানসহ আরও কয়েকজন কর্মচারী আমাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকা থামাতে বলেন। আমরা নৌকা থামালে তারা অন্য জেলেদের অবৈধ জাল নদী থেকে তুলে দিতে বলেন। আমি, রিপন ও রাসেল নদীতে স্রোত বেশি থাকার কথা বললে আমাদের তিনজনকে লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করেন মৎস্য অফিসের কয়েকজন কর্মচারী। এরপর তারা আমাদের মৎস্য অফিসের স্পিডবোটে তুলে নেন। সেখানেও আমাদের মারধর করা হয়। এ সময় গুরুতর আহত হন রিপন। 

আরো পড়ুন:

দেলোয়ার হোসেন আরও বলেন, এসএম মাহমুদুল হাসানের নির্দেশে আমাদের অন্য একটি ট্রলারে উঠিয়ে টুলু পয়েন্ট এলাকায় নিয়ে যায়। পরে তাদের কথামতো অবৈধ জাল তুলে দিলে আমাদের তারা কুপধন এলাকায় নামিয়ে দেয়। পরের দিন খবর পাই রিপনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আরেক জেলে কুপধন এলাকার নুরু মোল্লার ছেলে রাসেল হোসেন বলেন, আমরা এতদিন ভয়ে মুখ খুলিনি। ওই রাতে আমাদের খুবই পেটানো হয়েছে।রিপনের নাকের ওপরে একাধিক আঘাত করেছে লাঠি দিয়ে। আমি তাদের হাত-পা ধরে বলেছিলাম- রিপন মরে যাবে। ওকে এভাবে মাইরেন না। তারা কথা শোনেনি। 

রিপনের বাবা মো. আব্দুর রাজ্জাক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দিয়েছে নদীতে। আমি এই হত্যার বিচার চাই। আমাদের মামলা করার টাকা নাই। আমরা খাইতে পারি না, মামলা করমু কি দিয়া।’

তিনি আরও বলেন, ‘রিপনের স্ত্রী ও দুটি শিশু সন্তান আছে। রিপনের স্ত্রী এখন পাগলপ্রায়। ঠিকভাবে কথাও বলতে পারে না। আমি বৃদ্ধ মানুষ। আয়-রোজগারের শক্তি আমার শরীরে নাই। প্রতিবেশীরা খাবার দিলে দুই বেলা খাই। খাবার না দিলে আমরা না খেয়ে থাকি। ছোট ছোট দুটি শিশুর মুখেও খাবার দিতে পারি না।’

এ প্রসঙ্গে কালমেঘা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম নাসির বলেন, রিপনের মৃতদেহ উদ্ধারের সময় আমি সঙ্গে ছিলাম। ওর হাত-পা, নাক ও বুকের অনেক স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল। যেসব জেলেরা অবৈধ জাল ব্যবহার করে তাদের না পেয়ে ওদের কেন জাল তুলতে বলবে মৎস্য অফিস? রিপনের পরিবার এখন নিঃস্ব। আমি ব্যক্তিগতভাবে ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কিছু সহায়তা করেছি। এভাবে কতদিন সহায়তা করা যায় বলেন।

পাথরঘাটা থানার ওসি (তদন্ত) সাইফুজ্জামান বলেন, মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসার পরে হত্যার সত্যতা মিললে পরিবার মামলা না করলেও পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।

এ দিকে, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পুনরায় নির্যাতনের শিকার হওয়ার ভয়ে বিষখালী নদীতে কুপধন এলাকার জেলেরা মাছ শিকার বন্ধ করে দিয়েছেন। উল্লেখিত এলাকার কবির, রিয়াজ, মুসা, ইউসুফসহ একাধিক জেলে বলেন, মৎস্য অফিসের কর্মচারীরা প্রায়ই এমন নির্যাতন করে। অবৈধ জাল যারা ব্যবহার করে তারা মৎস্য অফিস থেকে কেউ আসলে পালিয়ে যায়। আমরা বৈধ জাল ব্যবহার করি। আমরা পালাই না। অথচ আমরা বৈধ জাল ব্যবহার করেও তাদের নির্যাতনের শিকার হই। রিপনের মৃত্যুর পর মৎস্য অফিস থেকে এই এলাকায় টহল বাড়িয়েছে। আমাদের হুমকি দিচ্ছে। তাই আমরা কোথাও অভিযোগ দিতে পারছি না। আমরা তাদের ভয়ে এখন আর বিষখালী নদীতে মাছ শিকারে যাই না।

সব অভিযোগ অস্বীকার করে বরগুনা সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এসএম মাহমুদুল হাসান বলেন, এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ওই রাতে আমরা ১২ জন অভিযানে গিয়েছিলাম। তবে, রিপন নামে কারোর সঙ্গে আমাদের  দেখা হয়নি। আমরা কাউকে মারধর করিনি। 

এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসিন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।  

বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। পুলিশ প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পরে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আপাতত ভুক্তভোগী পরিবারকে সহায়তার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছি।

ইমরান/মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়