ঢাকা     বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৯ ১৪৩১

ঘূর্ণিঝড়ের পর কেমন আছে মেঘনা পাড়ের শিশুরা

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৫, ১ জুন ২০২৪   আপডেট: ২০:০২, ১ জুন ২০২৪
ঘূর্ণিঝড়ের পর কেমন আছে মেঘনা পাড়ের শিশুরা

মেঘনার জলোচ্ছ্বাসে ঘর হারানো এক শিশু

পড়ন্ত বিকেলে শান্ত মেঘনা। ছড়াচ্ছিল তার অপরূপ সৌন্দর্য। অস্ত যাওয়া সূর্যের লাল আভায় এই নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে খেলায় মেতে উঠেছিল কয়েকজন শিশু। কিন্তু, অপরূপ সৌন্দর্যের মেঘনা ঘূর্ণিঝড় রেমালের সময় রুদ্র রূপ দেখিয়েছে। এই নদীর জলোচ্ছ্বাস কূলে বসবাসরত শিশুদের আশ্রয়স্থল কেড়ে নিয়েছে মুহূর্তের মধ্যেই। 

শুক্রবার (৩১ মে) বিকেলে শান্ত মেঘনার তীরে দেখা যায়, নিরাপদে খেলাধুলায় মেতেছে শিশুরা। কিন্তু, মাঝে মধ্যেই তারা মেঘনার অশান্ত রূপ দেখে। ভয়ঙ্কর রূপী মেঘনা ভয় ঢুকিয়ে দেয় কোমলমতি শিশুদের মনে। গত রোববার (২৬ মে) ঘূর্ণিঝড় রেমাল বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করে। সোমবার (২৭ মে) মেঘনা নদীতে দেখা দেয় জলোচ্ছ্বাস।  

১০ বছরের শিশু জিহান। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার নাছিরগঞ্জের মেঘনা নদীর তীরেই ছিল তার বসতঘর। পরিবারের সঙ্গে সেখানে বসবাস করতো সে। এখন বসতঘরটি আর নেই। কেড়ে নিয়েছে মেঘনায় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে উত্তাল মেঘনার তীরে যখন জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে, সে সময়  জিহান আশ্রয় নিয়েছিল তার খালার বাড়িতে। মেঘনার তাণ্ডবের সময় ঘরে ছিল তার বাবা-মা। মালামাল হারানোর ভয়ে তারা অন্যত্র যাননি। জলোচ্ছ্বাস তাদের পুরো ঘরটি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। জিহানের পরিবার এখন আশ্রয়হীন। আপাতত কয়েকদিনের জন্য খালাদের বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে জিহান ও তার পরিবারকে। 

ছোট জিহান বলে, ‌‘ধমায় (ঢেউ) সব নিয়া গেছে। আমাদের ঘরটি পর্যন্ত নিয়া গেছে। এখন খালাদের বাড়িতে থাকি।’

স্থানীয় একটি মাদরসার হেফজ বিভাগের ছাত্র মো. রাশেদ (১১)। জলোচ্ছ্বাসের দিন আতঙ্কিত হয়ে পড়া এ শিশুটিও তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছে। সে বলে, ‘অনেক ভয় লাগছে। বড় বড় ঢেউ হইছে। একেকটা ঢেউ অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে। আমার বুক পরিমাণ পানি হইছে। ঢেউয়ে মনে হয়, আমাদের নিয়ে যাবে, এমন আতঙ্কে ছিলাম। পরিবারের কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি, তাই আমিও যায়নি।’ 

আট বছরের শিশু রিয়ামনিদের ঘরের কিনারা পর্যন্ত পানি উঠেছিল। বাতাসের তীব্র বেগে যেন তাদের ঘরটি ভেঙে পড়েবে, এমন অবস্থা হয়েছিলো। খুব আতঙ্কে ওই সময়টি পার করার কথা জানায় রিয়ামনি। 

ইব্রাহিমের বয়স ৮। এ বয়সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছে মেঘনার। ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের সময় বাবা-মা ও তিন বোনের সঙ্গে ঘরেই ছিল সে। ঘরে পানি উঠে গেলে সবাই খাটের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। দীর্ঘ সময় এমন পরিস্থিতির মধ্যে কাটাতে হয়েছে তাকে। 

দশ বছরের আকরাম, ১১ বছরের রিয়ান ও ৭ বছরের নোহা আক্তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে খাটের ওপর দাঁড়িয়ে ঝড়ের রাতে সময় পার করেছে বলে জানিয়েছে। তারা বলে, জলোচ্ছ্বাসের সময় বড়দের বুক পরিমাণ পানি উঠে গেছে। আমাদের মাথার ওপর ছিল। বাবা-মারা অনেক কষ্টে আমাদের রক্ষা করছে। অনেক ভয়ে ছিলাম।

নদীর খুব তীরেই নুর জাহানদের ঘর। পাশের অনেকগুলো ঘর ভাসিয়ে নিয়েছে মেঘনার জলোচ্ছ্বাসের পানি। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় নুর জাহান তার ৩ বছর বয়সী নাতি সজীবকে নিয়ে ঘরেই ছিলেন। ঘরের মালামাল হারানোর ভয়ে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি। মেঘনার জলোচ্ছ্বাস ঘরের মালামাল ভাসিয়ে নিয়েছে তার। জলোচ্ছ্বাসের পানি যখন তাদের ঘরের চৌকির ওপর উঠে পড়ে, তখন সজীবকে তার মা বুকে আগলে রেখেছিলেন। ছোট শিশুটিকে নিয়ে খুবই আতঙ্কে সময় পার করেছেন নুর জাহান।

এদিকে, ঘূর্ণিঝড়ের আগেই কোনো কোনো পুরুষ অভিভাবক ঘরে অবস্থান নিলেও নারী ও শিশুদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আশ্রয়কেন্দ্রে। তাদের একজন জেলে আমির হোসেন। ঝড়ের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করার আগেই তিনি তার স্ত্রী এবং চার বছরের শিশু জুনায়েদ হোসেনকে কাছের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন। 

আমির হোসেন বলেন, ‘মালামাল হারানোর ভয়ে আমি ঘরে থেকে যাই। মালামাল তো দূরের কথা, ঘরটিও রক্ষা করতে পারিনি। জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব।’ 

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর ও সদরের আংশিক এবং কমলনগর ও রামগতি উপজেলার মেঘনার নদীর তীরে কি পরিমাণ শিশুর বসবাস- এর সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা না থাকলেও স্থানীয়দের মতে কয়েক হাজার শিশু মেঘনার তীরে বসবাস করে। এসব শিশুরা বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে বেড়ে উঠছে। 

স্থানীয় এক মাদ্রাসার শিক্ষক জানান, ঝড়ের আগে-পরে মেঘনাপাড়ের শিশুদের মনে ব্যাপক ভয় ঢুকেছে। এই স্মৃতি তাদের তাড়িয়ে বেড়াবে। অনাগত সব দুর্যোগে শিশুদের যাতে ক্ষতি না হয় সেজন্য তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। 

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম পাটওয়ারী বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থা কমিটি তালিকা অনুযায়ী বরাদ্দ চাওয়া হবে। বরাদ্দ পেলে উপকূলীয় ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের পরিবারকে সাহায্য করা হবে।

কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুচিত্র রঞ্জন দাস বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ঢেউ টিনসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য করা হবে। 

জাহাঙ্গীর/মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়