ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৯ ১৪৩১

সুন্দরবনের ঝুঁকি ৩৫ রিসোর্ট, জীববৈচিত্র্য হুমকিতে

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৮, ৩ জুন ২০২৪   আপডেট: ১৭:২৪, ৩ জুন ২০২৪
সুন্দরবনের ঝুঁকি ৩৫ রিসোর্ট, জীববৈচিত্র্য হুমকিতে

দাকোপ উপজেলার কৈলাশগঞ্জে সুন্দরবন ঘেঁষে গড়ে ওঠ একটি রিসোর্ট

খুলনার দাকোপ উপজেলার কৈলাশগঞ্জ ও বানিয়াশান্তা ইউনিয়নের সুন্দরবনে গড়ে উঠেছে অন্তত ৩৫টি রিসোর্ট। বন ঘেঁষে গড়ে ওঠা এসব রিসোর্টে প্রতিনিয়ত পর্যটকরা আসছেন। সামাজিক মাধ্যমে নানা চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে রিসোর্টগুলো পর্যটক টানছে। বেড়াতে আসা মানুষ সেখানে উচ্চস্বরে গানবাজনা ও ডিজে পার্টি করছেন। যা বনের জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা রিসোর্টগুলোর অনুমোদন নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এ বিষয়ে নিজেদের দায় এড়াতে স্থানীয় প্রশাসন ও বনবিভাগ একে অপরের দিকে আঙ্গুল তুলছে। 

কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে রিসোর্ট তৈরি করায় চতুর্মুখী সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এখনি কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে একদিকে বন ধংস হবে, অন্যদিকে বনে ঘুরতে আসা পর্যটকদেরও পড়তে হবে ঝুঁকিসহ নানা বিড়ম্বনায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি সুন্দরবনে আগুনে প্রায় ৭ একর বনাঞ্চল পুড়ে যাওয়ার পরই আলোচনায় উঠে এসেছে বিষয়টি। 

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের অধীনে বনবিভাগের লাউডোব টহল ফাঁড়ির ঠিক অপর পাশেই ‘বনলতা’ নামে একটি রিসোর্ট রয়েছে। ইকো রিসোর্ট বলা হলেও এর রুম, খাবার স্থান এবং ওয়াশ রুমের মেঝেতে কনক্রিটের টাইলস বসানো। সুন্দরবনের মাত্র ৫০ মিটারের মধ্যে রিসোর্টটিতে নিজস্ব ব্যবস্থায় দেওয়া সাউন্ডবক্সে বাজানো হয় ডিজে গান। রিসোর্টের ভেতরে মাত্র তিনটি রুম এবং সুন্দরবনমুখী খোলা জায়গা। জনপ্রতি ২০০ টাকা দিয়ে রিসোর্টের ব্যবস্থাপনায় নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হয় সুন্দরবনের ভেতরে। রিসোর্টটির রুমের নিচে পড়ে থাকা চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতল জোয়ারের পানিতে ভেসে যাচ্ছে বনের ভেতর। মাত্র ১০০ গজ দূরে থাকা বনবিভাগের টহল ফাঁড়ি এভাবে যে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে এ বিষয়ে কিছুই জানে না। 

আরো পড়ুন:

শুধু বনলতা নয়। দাকোপ উপজেলার কৈলাশগঞ্জ ও বানিয়াশান্তা ইউনিয়নে সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠছে ৩৫টি রিসোর্ট। এর মধ্যে ‌‘বনলতা’ ও ‘ম্যানগ্রোভ হ্যাভেন’ দুটি রিসোর্ট কৈলাশগঞ্জে। বাকি রিসোর্টগুলো বানিয়াশান্তায়। এলাকাটি ঘুরে দেখা যায়, ‘বনবাস’, ‘ইরাবতি’, ‘মাটির ময়না’, ‘জঙ্গলবাড়ি’, ‘নির্বাসন, ‘সুন্দরী’, ‘বনবিবি’ নামের রিসোর্ট রয়েছে। কয়েকটি রিসোর্টের নির্মাণ কাজ চলছে। এখনো ওই রিসোর্টগুলোর নাম নির্ধারণ করা হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বনলতা, বনবাস, ম্যানগ্রোভ হ্যাভেন, ইরাবতি, বনবিবিসহ কয়েকটি রিসোর্টে প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটক আসেন। তারা হরহামেশা বনের মধ্যে প্রবেশ করছেন। বিড়ি-সিগারেট ও চিপসের প্যাকেট ফেলছেন নদীর পানিতে। যার ফলে হুমকিতে পড়েছে সুন্দরবন।

হুমকিতে সুন্দরবন জীববৈচিত্র্য: 

একের পর এক রিসোর্ট নির্মাণ হওয়ায় হুমকিতে পড়তে যাচ্ছে সুন্দরবন এবং এ এলাকার জীববৈচিত্র্য। সুন্দরবনের লাউডোব টহল ফাঁড়িতে সিপিজি হিসাবে কাজ করা শর্মিলা জানান, বন এক জায়গায়, এর লোকালয় এক জায়গায়। এরপরও বন রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এখন একের পর এক রিসোর্ট তৈরি করে প্রচুর মানুষ প্রতিনিয়ত সুন্দরবনে অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করছে। তারা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। অনুমতি না নিয়ে বনের ভেতরে প্রবেশ করে ব্যবহার্য প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলছে, উচ্চস্বরে গান বাজাচ্ছে। তারা বিভিন্নভাবে বনের ক্ষতি করছে। বনবিভাগ বা কাউকে তারা তোয়াক্কা করে না।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, ‘সুন্দরবনের মধ্যে অবাধ বিচরণের বিষয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ আইন-২০১৪ আছে। যেটা অবশ্যই মানতে বাধ্য সব ভ্রমণকারী। সরকারের এই মুহূর্তে সুরক্ষা নামের একটি প্রজেক্টের আওয়াতায় ইকো-ট্যুরিজম একটা বিষয় আছে। একটি কটেজ করতে হলে অনেকগুলো বিষয় মানা উচিত, এর নীতিমালা থাকা উচিত। অচিরেই নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে বন বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনের দায় এড়ানো বা সমন্বয়হীনতার কোনো সুযোগ নেই। 

বনবিভাগ ও প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা: 

সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে একের পর এক ইকো-রিসোর্টের নামে যে স্থাপনা তৈরি হচ্ছে এবং অনুমতি না নিয়ে সুন্দরবনে অবাধ বিচরণে স্থানীয় প্রশাসন ও বনবিভাগ একে অপরের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলছে। কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিহির রঞ্জন অধিকারী বলেন, ‘আমার এলাকা এবং বানিয়াশান্তা এলাকায় মোট ৩৫টি রিসোর্ট হয়েছে। এর কয়েকটি আমার এলাকায়। আমরা শুধু ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছি।’ 

ইকো ক্রিটিক্যাল এরিয়ার ভেতরে স্থাপনার অনুমতি দেওয়ার আগে সব কিছু বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিলো কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে এই বিষয়ে আমার তেমন কোনো জ্ঞান নেই।’

খুলনা বিভাগীয় বন অফিসের সদর অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাসান বলেন, ‘বনে আমাদের একটা নির্দিষ্ট সীমানা আছে। এর এক ইঞ্চি দূরেও যে কেউ কোনো কিছু করলে এটার দেখার এখতিয়ার আমাদের না। বনের মধ্যে ঢুকে কেউ কিছু করলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। আমরা এসব বিষয় সমন্বয় মিটিংয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলার চেষ্টা করলে স্থানীয় প্রশাসন আমাদের কথা শোনে না। আমাদের এখানে কিছু করার নেই।’

দাকোপ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জয়দেব চক্রবর্তী বলেন, ‘রিসোর্ট কয়েকটি হয়েছে। আমি আসার আগেই সেগুলো হয়েছে। কেউ কোনদিন কোনো ধরনের অনুমতি নিতে আসেননি। এগুলো করতে কোনো অনুমতি আদৌ লাগে কি না বিষয়টি আমার জানা নেই। বিষয়টি আমরা অবশ্যই খোঁজ নেবো। এসব বিষয়ে মিটিং আহ্বান করলে বন বিভাগের কর্মকর্তারা মিটিংয়ে আসেন না। আমাদের কিছু জানান না। আমরা তাদের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পাই না।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরবন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, ‘ইকো ট্যুরিজমের নামে যা হচ্ছে, এর মূল্য একদিন দিতে হবে। এখনও চিন্তা করার সুযোগ আছে। এখনই একটি নীতিমালা তৈরি করতে হবে। নীতিমালা না হলে ইকো ট্যুরিজম আমাদের আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হিসাবে দেখা দেবে।’

মাসুদ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়