ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৪ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২০ ১৪৩১

কিনেছেন শত বিঘা জমি

বনের জমিতে বেনজীরের ‘ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’

রেজাউল করিম, গাজীপুর  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১২, ৪ জুন ২০২৪   আপডেট: ১৩:৩৬, ৪ জুন ২০২৪
বনের জমিতে বেনজীরের ‘ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’

বেনজীর আহমেদ। ছবি: ফেসবুক

শাল-গজারি ঘেরা বনের ভেতর বিলাসবহুল ‘ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীরের দাপটে সরকারি বন ধ্বংস করে গড়ে তোলা হয়েছে পাঁচতারকা মানের এই রিসোর্ট। এ ছাড়াও বেনজীর আহমেদ গাজীপুরের কালীগঞ্জে কিনেছেন নামে-বেনামে শতবিঘা জমি। সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

পড়ুন: বেনজীর আহমেদের সাভানা পার্ক বন্ধ ঘোষণা

অভিযোগ উঠেছে, গাজীপুরের বারুইপাড়া মৌজার নলজানি এলাকায় কৌশলে বনের ভেতরে প্রথমে ব্যক্তি মালিকানা কিছু জমি কেনেন বেনজীর আহমেদ। পরবর্তীতে আশপাশের ৬ একর ৭০ শতাংশ বনের জায়গা দখল করে গড়ে তোলেন ‘ভাওয়াল রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’। একই সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের জিম্মি করে দখল করে নেন প্রায় ৩ একর কৃষি জমি। জনশ্রুতি রয়েছে, বিলাসবহুল রিসোর্টটির দখল বাণিজ্যে মাথা হিসেবে থেকে ২৫ শতাংশ শেয়ার পেয়েছিলেন বেনজীর আহমেদ।

ভুক্তভোগীরা জানান, রিসোর্টের মূল ফটকের সামনে বানানো পাহাড় এবং ভেতরের জমি তাদের ছিল। মূল্য পরিশোধ না করেই জমি বেদখল করে নেওয়া হয়েছে। বেনজীর আহমেদের কারণেই রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ এসব করার সাহস পেয়েছে। স্থানীয় কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে দাবি করেছেন, তাদের জমি বেদখল করেই রিসোর্টটি তৈরি করা হয়েছে। 

গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আদালতে এতদিন স্টে অর্ডার থাকায় কিছু করা যায়নি। এখন আদালত রায় দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে সময়মতো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সরকারি জমি উদ্ধার করা হবে। ’

অন্যদিকে, রাজধানীর পূর্বাচল উপশহর ঘেঁষে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়ন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা এবং পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা পূর্বাচলের অতিনিকটে হওয়ায় এখানে জমির দাম আকাশ ছোঁয়া। সেখানেও বেনজীর আহমেদ এবং তার স্ত্রী-সন্তানের নামে জমি রয়েছে। কালীগঞ্জ সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে তল্লাশি চালিয়ে সম্প্রতি বেনজীর, তার স্ত্রী ও বড় মেয়ের নামে ৬টি দললি পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বেতুয়ারটেকের বাসিন্দা প্রভাত কস্তা ও বাবুল মল্লিক বলেন, ‘২০১৬ ও ২০১৭ সালে বেনজীর আহমেদ এলাকায় জমি কেনা শুরু করেন। ওই সময় এলাকায় জমির বিঘা প্রতি দাম ছিল ১৬ থেকে ১৭ লাখ টাকা।’ বেনজীর আহমেদ, স্ত্রী জীশান মির্জা এবং বড় মেয়ে ফারহীন রিশতার নামে জমিগুলো কেনা হয় বলেও জানান তারা। 

সাইনবোর্ডে লেখা থাকলেও বর্তমানে লাল রং দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ছবি: রাইজিংবিডি

নাগরীর পাঁচ নাম্বার ওয়ার্ডের পুইন্নারটেক গ্রামের সুশীল মণ্ডল ঢাকার তাঁতীবাজারে স্বর্ণের ব্যবসা করেন। তিনি প্রথম গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়ন চান্দখোলা মৌজার বেতুয়াটেক গ্রামে বেনজীর আহমেদের কাছে জমি বিক্রি করেন। তিনি করোনার আগে স্থানীয় জমির দালাল আব্দুল মোমেনের মাধ্যমে ৯ বিঘা জমি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের কাছে বিক্রি করেছেন বলে জানান। প্রতি বিঘা জমির দাম তিনি পেয়েছেন ১৫ লাখ টাকা।

সুশীল মণ্ডল বলেন, ‘শুধু আমি নই, আমার মতো আরও অনেকের কাছ থেকে প্রায় শতাধিক বিঘা জমি কিনেছেন বেনজীর। শুনছি পরবর্তীতে তিনি অনেক জমি বিক্রি করে দিয়েছেন।’

কালীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার এবং রাজধানীর উপশহর পূর্বাচল থেকে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে নাগরী ইউনিয়ন চান্দখোলা মৌজার বেতুয়াটেক গ্রাম। সেই গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায় বড় বড় লাল রংয়ের সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডগুলো সিমেন্ট দিয়ে তৈরি। বিস্তৃত এলাকাজুড়ে শতাধিক এমন সাইনবোর্ড দেখা যায়। একসময় সাইনবোর্ডে লেখা থাকলেও বর্তমানে লাল রং দিয়ে সেই লেখা ঢেকে দেওয়া হয়েছে।

বেনজীর ও তার পরিবারের নামে কেনা বিভিন্ন দলিলের মধ্যে ৬টি দলিল ঘেটে দেখা গেছে, ৫১২/১৭ নাম্বার দলিলে কালীগঞ্জের বান্দাখোলা গ্রামের মৃত সুধীর দাসের ছেলে সুদেব দাসের কাছ থেকে ৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকায় ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ৮৩৬০/১৬ নাম্বার দলিলে বেতুয়ারটেক গ্রামের মৃত নরেশ মল্লিকের ছেলে কাশীনাথ মল্লিক, পরেশ মল্লিক ও আশুতোষ মল্লিক ওরফে আশু মল্লিকের কাছ থেকে ৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকায় ১১ দশমিক ৮৭১ শতাংশ, ২০৩৮/২০১৭ নাম্বার দলিলে ছাইতান গ্রামের মৃত সিলভেস্টার রোজারিওর ছেলে প্রদীপ রোজারিও এবং তার মেয়ে তারামনি এসেনের কাছ থেকে ৮ লাখ ৪২ হাজার টাকায় ২৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ, ১৯৭৩/১৭ নাম্বার দলিলে পাড়ারটেক গ্রামের মৃত জন লোপেজ টছকানুর ছেলে হেনরি টছকানু, রিচার্ড টছকানু, রায়মন রোনাল্ড টছকানু ও দুই মেয়ে মিসেস রেবেকা কুইয়া ও রিনা টছকানুর (এমিলি) থেকে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকায় ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং ৯০৯৮/১৭ নাম্বার দলিলে পূণ্যেরটেক গ্রামের মৃত হরেন্দ্র চন্দ্র্র গোপের ছেলে আশুতোষ ঘোষ ও সুশীল ঘোষের কাছ থেকে ১১ লাখ ৮৭ হাজার টাকায় ৪০ দশমিক ৭৩৯ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। ওই সময় এসব জমির দাম ৪-৫ গুণ বেশি থাকলেও দলিলে কম মূল্য দেখিয়ে রেজিষ্ট্রি করেন বেনজীর আহমেদ।

সাইনবোর্ডে লেখা থাকলেও বর্তমানে লাল রং দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে। ছবি: রাইজিংবিডি

কালীগঞ্জর উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে  জানা গেছে, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে  উপজেলার তুমুলিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে বেনজীর আহমেদ, স্ত্রী জীশান মির্জা এবং বড় মেয়ে ফারহীন রিশতার নামে মোট ৯টি জোত খোলে জমি নামজারি জমাভাগ করা হয়। তার মধ্যে ২০৭ জোতে ২৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ, ২০৮ জোতে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ, ২১৩ জোতে ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশ, ২১৫ জোতে ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ ২২৬ জোতে ৪১ শতাংশ, ২৫০ জোতে ২৫ দশমিক ৫০ শতাংশ, ২৭৬ জোতে ১৪ শতাংশ, ২৭৭ জোতে ৩৫ শতাংশ, এবং ২৮৬ জোতে ১৫ শতাংশ জমি নামজারি জমা ভাগ হয়েছে। এছাড়া তার বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের নামে আরও ১৯টি নামজারি জমাভাগ (খারিজ) পাশাপাশি সময়ে করা হয়েছে।

কালীগঞ্জ উপজেলা সাব-রেজিষ্ট্রার মো. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘দুদক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে কেনা সম্পদের তথ্য চেয়ে ছিল। এখন পর্যন্ত আমরা বেনজীর ও তার পরিবারের নামে ৬টি দলিল পেয়েছি। পরে সেগুলো দুদক অফিসে গিয়ে দিয়ে এসেছি।’

পড়ুন

বেনজীর আহমেদের অবস্থান নিয়ে ধূম্রজাল

বেনজীর, স্ত্রী ও মেয়ের বিও হিসাব অবরুদ্ধ

মাদারীপুরে স্ত্রীর নামে ২৭৬ বিঘা জমি কিনেছেন বেনজীর

বান্দরবানে বেনজীরের ২৫ একর জমি, দেখভাল করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি

/এসবি/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়