ঢাকা     শনিবার   ০৬ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২২ ১৪৩১

চিকিৎসক নেই তবুও চলছে পথেরবাজার ক্লিনিক 

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:২৭, ৪ জুন ২০২৪   আপডেট: ২০:৩৩, ৪ জুন ২০২৪
চিকিৎসক নেই তবুও চলছে পথেরবাজার ক্লিনিক 

প্রশাসনের উদাসীনতা বা পরস্পর যোগসাজশ— এভাবে চলছে খুলনার দিঘলিয়ার পথেরবাজার সার্জিক্যাল ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনেস্টিক সেন্টার। স্বাস্থ্যসেবার নামে চলছে অমানবিক চিকিৎসা বাণিজ্য।

এই ক্লিনিকের নিজস্ব চিকিৎসক নেই। অথচ একাধিক চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করে বোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকের জাল স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করে বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্ট দেন সেখানকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাম ম্যানেজার এস কে নূর মোহাম্মদ। এমনকি, তিনি নিজে চিকিৎসক সেজে চিকিৎসা দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেলেও শুধু ‘সতর্ক’ করে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, বরং অকারণে সময়-ক্ষেপণ করা হচ্ছে। 

সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে পথেরবাজার সার্জিক্যাল ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনেস্টিক সেন্টার। অনুমোদন না নিয়ে অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সেই তথ্য নেই খোদ খুলনার সিভিল সার্জন অফিসে। 

অভিযোগ রয়েছে, রোগীদের সিজারিয়ানসহ নানা ধরনের অপারেশন করা হচ্ছে ক্লিনিকে ভাড়া (অন-কল) করা চিকিৎসক দিয়ে। চিকিৎসকদের দিয়ে শুধু অস্ত্রোপচার করিয়ে নিয়ে বাকি কাজ করেন ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। অথচ ক্লিনিকের সামনে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করে সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে রাখা আছে। যার বেশিরভাগ চিকিৎসক ক্লিনিকে আসেন না।

খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গাস্থ শের-এ-বাংলা রোড এলাকার বাসিন্দা ডা. শাবনাজ সারোয়ারের পক্ষে তার বাবা গোলাম সরোয়ার বিশ্বাস গত বছরের ৬ ডিসেম্বর দিঘলিয়া খানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, তার কন্যা ডা. শাবনাজ সারোয়ার পথেরবাজার ক্লিনিকে অস্থায়ী (অন কল) আলট্রাস্নোলজিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ৮ মাস আগে ওই ক্লিনিক থেকে অব্যাহতি নেন। পরবর্তীতে ৬ এপ্রিল ওমরা হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যান। সেখান থেকে ২৯ এপ্রিল দেশে ফেরেন। সৌদি থাকাকালীন ৯ এপ্রিল ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তার মেয়ের নামে সিলসহ স্বাক্ষরিত অন্তঃসত্ত্বা রিপোর্ট মিসেস তাছলিমা খানম নামে রোগীকে দেয়। ওই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে ভূক্তভোগী রোগী মামলা করেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে লোহাগড়া খানা থেকে তার মেয়েকে নোটিশ দেওয়ায় বিষয়টি তিনি জানতে পারেন।

খুলনার সিভিল সার্জন বরাবর ২৮ এপ্রিল দাখিল করা লিখিত অভিযোগে নগরীর মুজগুন্নি আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ডা. ফারজানা খানম উল্লেখ করেন, তিনি চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পথেরবাজার ক্লিনিকে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় হাসপাতালের মালিক রবির শ্যালক নূর মোহাম্মাদ ভারপ্রাপ্ত মালিক ছিলেন। এ সুবাদে তিনি ডা. ফারজানা খানমের অনুমতি ছাড়াই নাম ব্যবহার করে ও স্বাক্ষর জাল করে ভুল আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট তৈরি করেন।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, নুর মোহাম্মাদ অষ্টম শ্রেণি পাস হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করে আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট ও প্রেসক্রিপশন করে থাকেন। ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল হওয়ায় দুই জন ডিপ্লোমা নার্স থাকার কথা থাকলেও শুধু একজন আছে। এমনকি ওটি সহকারীর কাজ করা বৈশাখীরও সার্টিফিকেট নেই। 

তিনি আরও অভিযোগ করেন, এ ক্লিনিকে গর্ভবতীদের নরমাল প্রসব করতে দেওয়া হয় না। কর্মস্থল নিরাপদ মনে না করায় তিনি ওই প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। এ কারণে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাকে হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। তিনি এ বিষয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান।

অভিযোগের বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জনের নির্দেশে বিষয়টি তদন্তের জন্য দাকোপ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুদীপ বালাকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। 

পথেরবাজার ক্লিনিকের পরিচালক নুর মোহাম্মাদ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এখানে সব ধরনের টেস্ট হয়। খুলনা সির্ভিল সার্জন থেকে অনুমোদন না দিলে আমরা ক্লিনিক চালাতে পারি না।’ তবে ক্লিনিকের লাইসেন্স এখনও হাতে পাননি বলে স্বীকার করেন।

ডা. শাবনাজ সারোয়ারের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে একটা আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট করা হয়েছে বলেও স্বীকার করে নুর মোহাম্মাদ।

এ বিষয়ে খুলনা সির্ভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার শেখ সাদিয়া মনোয়ারা উষা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘একটা অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১৫ মে পথেরবাজার ক্লিনিকে গিয়েছিলাম। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।’ 

দিঘলিয়া উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহাবুব আলম এ প্রতিবেদককে বলেন, পথেরবাজার ক্লিনিক বন্ধ রাখার জন্য প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারকে ডেকে বলে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি চালু থাকলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। 

এ বিষয়ে খুলনার সিভিল সার্জন শেখ শফিকুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘পথেরবাজার ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিন সদস্যের তদন্ত টিম করে দিয়েছিলাম। তারা তদন্ত করে রিপোর্ট আমার কাছে দাখিল করেন। যাতে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এ কারণে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে প্রাথমিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে।’ 

নুরুজ্জামান/বকুল  

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়