ঢাকা     বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১০ ১৪৩১

উপকূলের অর্ধেক জমি লবণাক্ত: কমছে কৃষি উৎপাদন, বাড়ছে রোগ

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৪, ৫ জুন ২০২৪  
উপকূলের অর্ধেক জমি লবণাক্ত: কমছে কৃষি উৎপাদন, বাড়ছে রোগ

ছবি: রাইজিংবিডি

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলীয় এলাকার ৫৩ শতাংশ জমি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। এতে সেখানকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন, কৃষি ব্যবস্থাপনা, মিঠা পানির মাছ ও বন্যপ্রাণীর ওপর প্রভাব পড়ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড এ দুই বিষয়কেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকেই মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

লবণাক্ততা বাড়ায় দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় কৃষির ক্ষতির পাশাপাশি সেখানকার বাসিন্দারা উচ্চ রক্তচাপ, কিডনির জটিলতাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউেটটের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জি এম মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেছেন, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার মধ্যে বর্তমানে খুলনার কয়রার শিপসা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনির মরিচ্চাপ নদীতে লবণাক্তার পরিমাণ বেশি। এ তিনটি জেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে লবণাক্তার পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন। নদীর পানি লবণাক্ত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষিজমিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

আরো পড়ুন:

‘উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকার সমস্যা ও উন্নয়ন সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায় দুটি প্রাকৃতিক কারণে—জোয়ারে বা জলোচ্ছ্বাসে লবণযুক্ত পানি জমিতে প্লাবিত হয়ে এবং ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি কৈশিক রন্ধ্র দিয়ে মাটির উপরে চলে এসে। সাধারণত, শুকনো মৌসুমে (মার্চ-মে) লবণাক্ত জোয়ারের পানিতে বহু জমি তলিয়ে যায়। এ পানি সেচকাজে ব্যবহার করা হলে মাটি বা জমি লবণাক্ত হয়। অন্যদিকে, বর্ষা শেষ হলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মাটি শুকাতে শুরু করে। মাটিতে অনেক ফাটল সৃষ্টি হয়। তখন মাটির ওপরে রোদ পড়লে উপরিস্তর থেকে পানি বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে চলে যায় এবং ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানি ওই ফাটল দিয়ে ভূমির উপরিস্তরে চলে আসে। জমির উপরিস্তর লবণাক্ত হয়। মনুষ্যসৃষ্ট কারণেও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। উপকূলীয় অনেক এলাকায় মৎস্যচাষিরা লবণাক্ত পানির ঘের তৈরি করে চিংড়ি চাষ করেন। এতে ঘেরের মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়।

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯ জেলার ১৪৮টি উপজেলার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার ঝুঁকিতে রয়েছে ১০ উপজেলার নদীর পানি। সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালীগঞ্জ উপজেলা; খুলনার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলা; বাগেরহাটের মংলা এবং পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় এখন ১০ পিপিটি (প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত লবণ) মাত্রার লবণাক্ততা রয়েছে। অথচ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, লবণের সহনীয় মাত্রা দশমিক শূন্য ৫ টিটিপি। আগামীতে তা ১৫-২৫ পিপিটি মাত্রায় উন্নীত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩২ শতাংশ ভূমিতে বসবাস করছে, প্রায় ৪ কোটি মানুষ, যা মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ। এ অঞ্চলের মাত্র ৩০ শতাংশ জমি এখন চাষযোগ্য। ১৭ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে মাছ চাষসহ অন্যান্য কাজে। ৫৩ শতাংশ জমি পতিত রয়েছে শুধু লবণাক্ততার কারণে। চাষযোগ্য ৩০ শতাংশ জমি আবার পরিপূর্ণভাবে উৎপাদনে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক সংস্থা প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দক্ষিণবঙ্গের জেলা, বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার কৃষিজমি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। চিংড়ি চাষের জন্য নোনা পানি আনতে স্লুইসগেট ছিদ্র করে বাঁধ দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে এসব এলাকায় সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতা। 

উপকূলীয় জেলায় খাবার পানির মারাত্মক সঙ্কট চলছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে পুকুরের মতো মিঠা পানির উৎস শুকিয়ে যাচ্ছে এবং টিউবওয়েলেও পানি দিন দিন কমে আসছে। লবণাক্ত ও দূষিত পানি ব্যবহার করার ফলে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দিচ্ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, মানুষের শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণের প্রয়োজন। সেটি আসে খাদ্য ও পানি থেকে। কিন্তু, উপকূলীয় এলাকার পানিতে লবণের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। এই পানি শরীরে প্রবেশ করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। গর্ভবতী নারীদের জন্য তা বেশি বিপজ্জনক। গর্ভাবস্থায় নারীরা বেশি লবণাক্ত পানি খেলে খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। এ কারণে নারীদের গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার হারও বেশি, যা বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, লবণাক্ততার কারণে উপকূলের নারীরা শুধু অকালগর্ভপাতের শিকার হন না, ৩ শতাংশ শিশুও মারা যায়। বেশি লবণ খাওয়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

‘উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকার সমস্যা ও উন্নয়ন সম্ভাবনা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জমিতে লবণাক্ততার কারণে বর্ষাকালে শুধু আমন ধানের উৎপাদন হয়। এছাড়া, সারা বছর পতিত থাকে। শুষ্ক মৌসুমে মিষ্টি পানির অভাবে বোরো ধান আবাদ করা সম্ভব হয় না।

এ গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, লবণাক্ততার কারণে উদ্ভিদের বৃদ্ধি কমে যায়, ফুলের সংখ্যা হ্রাস পায়। অনেক ক্ষেত্রে পরাগায়নও হয় না। ফলে, ফসলের ফলন বিভিন্ন মাত্রায় কমে যায়। মাটি লবণাক্ত হওয়ার কারণে মৃত্তিকা দ্রবণের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়।

গবেষণায় লবণাক্ত এলাকার কৃষিতে বিপ্লব আনয়ন সম্ভব, উল্লেখ করে বলা হয়, লবণসহিষ্ণু ফসল ও জাতের উদ্ভাবন এবং আধুনিক চাষ প্রযুক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। ভুট্টা লবণসহিষ্ণু ফসল। তাই, কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে স্থানীয় জাতের ধানের পরিবর্তে স্বল্প মেয়াদি আধুনিক জাতের বা হাইব্রিড জাতের ভুট্টা আবাদ করা যেতে পারে। লবণাক্ত এলাকায় লবণাক্ত-সহনশীল ফসল যেমন: সূর্যমুখী, রেড বিট, সয়াবিন ইত্যাদি চাষ করতে হবে। এছাড়া, ঘেরের পাড়ে প্রায় সারা বছর সবজি ও তরমুজ চাষ করা যেতে পারে।

/বকুল/রফিক/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়