কৃষকের পকেট কাটছে কারা?
মাসুম লুমেন, গাইবান্ধা || রাইজিংবিডি.কম
![কৃষকের পকেট কাটছে কারা? কৃষকের পকেট কাটছে কারা?](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2024June/Gaibandha-2406071206.jpg)
ক্রেতা-বিক্রেতায় জমজমাট ফুলছড়ির মরিচের হাট
‘খাজনা দেওন (দেওয়া) লাগে মণ প্রতি ৮০ ট্যাকা, কাটা (ওজন) করতে দেওন লাগে মণ প্রতি ৮০ ট্যাকা। আবার এক মণ শুকনো মরিচ লোড-আনলোড করতে লেবারকে (শ্রমিক) দেওন লাগে বস্তা প্রতি ৮০ ট্যাকা। নদী ভাঙতে ভাঙতে হাটের জায়গাও এখন কমি গেছে। হাটত এমন কোন জায়গা নাই যে, ঝড়-বৃষ্টি হলে মাল নিয়ে সেখানে আশ্রয় নিতে পারুম (পারবো)। অনেক কষ্ট করি মরিচ আবাদ করি। কম ট্যাকা খরচ হলে হামার জন্য ভালো হতো। এমনিতেই এবার মরিচের দাম গত বছরের তুলনায় অনেক কম। এক মণ মরিচ বেচপ্যার (বেচা) আসি এমরা যেভাবে অর্থ চুষি নেয়, এটা হামার মতো কৃষকের উপর জুলুম ছাড়া আর কিছুই নয়’
এভাবেই হতাশা নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার এড়েন্ডাবাড়ি চর থেকে আসা মরিচ চাষি ছামাদ মিয়া। গত মঙ্গলবার তিনি ফুলছড়ির গজারিয়া ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র ঘাট সংলগ্ন হাটে শুকনো মরিচ বিক্রি করতে এসেছিলেন।
ভুট্টার পাশাপাশি জেলার ব্রান্ডিং পণ্য শুকনো লাল মরিচ। প্রতি বছরের মতো এবারও গাইবান্ধার ফুলছড়িতে মরিচের বাম্পার ফলন হয়েছে। নদী বেষ্টিত এই জেলার সাত উপজেলার ১৬৫ চরে মরিচ চাষ বেশি হয়। জেলার একমাত্র মরিচের হাট বসে ফুলছড়ি হাটে। এতবড় মরিচের হাট উত্তরবঙ্গের আর কোথাও নেই।
ঐতিহ্যবাহী এই হাটে বিশ্রামাগার না থাকা, পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি পানের ব্যবস্থা না থাকা, অতিরিক্ত খাজনা আদায়, লেবার ফি, আড়তদারি থেকে মণ প্রতি কাটা (ওজন) করতে এক কেজি মরিচ নেওয়ারও অভিযোগ তুলেছেন অনেক কৃষক ও পাইকাররা। এদিকে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ইজারাদারকে সরকার নির্ধারিত খাজনা আদায়ের মূল্য তালিকা হাটে টাঙিয়ে রাখার নিয়ম থাকলেও এমন দৃশ্য দেখা যায়নি।
হাটের এই ছোট ঘরটিতে বিশ্রাম নিচ্ছেন বাজারে পণ্য বিক্রি করতে আসা কয়েকজন কৃষক
ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর ১৪ এপ্রিল থেকে (১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১ বৈশাখ থেকে) আগামী এক বছরের জন্য ফুলছড়ি হাটের সরকারি ইজারা মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৫৭ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা। টেন্ডারের মাধ্যমে পরবর্তীতে ফুলছড়ি হাটের ইজারা মূল্য নির্ধারণ হয় ৮২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। হাটের ইজারা পান অ্যাডভোকেট নুরুল আমিন নামের এক ব্যক্তি।
গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরের পথ ফুলছড়ি হাটের। প্রসস্থ সড়ক গাইবান্ধা থেকে বগুড়ার সোনাতলা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় সব ধরনের যানবাহনে সরাসরি যাওয়া যায় এই হাটে। উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র ঘাট সংলগ্ন স্থানে অবস্থিত হাটটি। সপ্তাহে দুই দিন শনিবার ও মঙ্গলবার বসে এই হাট। চলে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। প্রতি হাটে তিন থেকে চার কোটি টাকার শুকনো মরিচ বিক্রি হয়। সেই হিসেবে মৌসুম সময়ে মাসে গড়ে প্রায় ৩০ কোটি টাকার মরিচ বিক্রি হয় এই হাটে।
ফুলছড়ি ছাড়াও বিভিন্ন চর থেকে এই হাটে প্রচুর মরিচ আনেন কৃষক ও পাইকাররা। এরমধ্যে টেংরাকান্দি, মোল্লারচর, খোলাবাড়ি, ফজলুপুর, এরেন্ডবাড়ি, উড়িয়া, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি চর অন্যতম। এছাড়া, পার্শ্ববর্তী জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বকশিগঞ্জের কয়েকটি চর থেকেও মরিচ বিক্রি করতে আসেন কৃষক ও পাইকাররা।
সরেজমিনে দেখা যায়, মরিচের জন্য প্রসিদ্ধ এই হাটে শত শত কৃষক ও পাইকাররা বস্তায় শুকনো মরিচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বিক্রির জন্য। মরিচের লাল আভায় রঙিন হয়ে উঠেছে চারপাশ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ক্রেতা এবং বিক্রেতারা মরিচের দর কষাকষি করছেন। দাম মিললেই মরিচের বস্তা ট্রাকে, পিকআপে লোড করা হচ্ছে। পরে এই মরিচ নিয়ে যাওয়া হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাট-বাজারে।
হাটেই এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় মরিচ বিক্রি করতে আসা কৃষক হামিদুল মির্জার। তিনি এসেছেন ফুলছড়ি উপজেলার জিগাবাড়ি চর থেকে।
হামিদুল মির্জা বলেন, ‘হাটে ২০ মণ মরিচ নিয়ে এসেছি। চর থেকে মরিচ নিয়ে আসাটা খুব কঠিন। কখনো নৌকায়, কখনো মাথায়, কখনো আবার ঘোড়ার গাড়িত করি মরিচ নিয়্যা আইচি। গত বছর মরিচের মণ ছিল ১৫ থেকে ১৮ হাজার ট্যাকা। হাট শ্যাষের দিকে। এখনো মরিচ বিক্রি হয়নি। এই হাটে এক মণ শুকনো মরিচ বিক্রি করতে ১০০ ট্যাকা দেওন লাগে। কাটা (ওজন) করতে এক মণ মরিচে এক কেজি মরিচ নেয়। হামরা রোদত (রোদ) দাঁড়ে থাকি মরিচ বিক্রি করি। মাথার ওপর একটা চালাও নাই। হাটত (হাটে) একটা টিউবওয়েল পর্যন্ত নাই। এতো রোদত পিপাসা লাগলে মালের বস্তা থুয়্যা, পানি খাওয়ার জন্য সেই দূরে হাটের ভেতর যাওয়া লাগে। একটা বাথরুমও নাই। হামরা কষ্ট করি আবাদ করি, আর ওমরা (হাট কর্তৃপক্ষ) বিভিন্ন অজুহাতে খালি ট্যাকা (টাকা) নেয়।’
পাইকার শাহ জামাল মিয়া মরিচ বিক্রি করতে এসেছেন ফজলুপুর ইউনিয়নের খাটিয়ামারির চর থেকে। তিনি বলেন, ‘৫০ মণ মরিচ নিয়ে এসেছি। বেশি দামে গ্রামে মরিচ কিনেছিলাম। হাটে মরিচের দাম কম। প্রতি মণ শুকনো মরিচ ১০ থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। তবে, হাটে লেবার এবং খাজনা খরচ বেশি। আমাদের অবশ্য গৃহস্থের (কৃষকের) মতো কাটা করতে এক কেজি মরিচ দেওয়া লাগে না। ৬০ টাকা দিলেই হয়।’
সাঘাটা থেকে মরিচ বিক্রি করতে এসেছিলেন কৃষক লাল মিয়া। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘গত বছর ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা মরিচের মণ বিক্রি করেছি। এবার প্রতি মণ শুকনো মরিচের দাম ১০ হাজার টাকা বলছে। একদিকে দাম কম, অন্যদিকে হাট ইজারাদারকে ৮০ টাকা দিতে হয়। আবার, এক মণ মরিচ কাটা (ওজন) করতে এক কেজি ফ্রি দেওয়া লাগে। এক কেজি মরিচের বাজার মূল্য প্রায় ২৫০ টাকা। সবচেয়ে বড় সমস্যা, এখানে কোনো বাথরুম নেই।’
গজারিয়ার চর থেকে এসেছেন কৃষক মমতাজ আলী। বৃদ্ধ এই কৃষক বলেন, ‘দিন যায়, আবাদের খরচ বাড়ে আর মরিচের দাম কমে। বর্তমানে শুকনো মরিচ প্রতি মণ ১০ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৯ হাজার টাকা দাম চলছে। যারা কাটা (ওজন) করে, তাদেরকে এক মণ মরিচে এক কেজি মরিচ দেওয়া লাগে। মণ প্রতি খাজনা দেওয়া লাগে ৮০ টাকা। কারও কারও কাছে ১০০ টাকাও নেয়। তারপরও হাটে এসে কোনো শান্তি নাই। এতবড় একটা হাট, অথচ কোনো বাথরুম নেই। হাট মালিক খালি টাকা নেয়, কোনো সুযোগ সুবিধা তো দেয় না।’
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ মার্চ জেলার সাত উপজেলার হাট-বাজারগুলোর টোল আদায় ও এর নিয়ম-কানুন সম্পর্কে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক কাজি নাহিদ রসুল।
চিঠির সূত্র ধরে জানা যায়, বিভিন্ন পণ্যের টোল (খাজনা) আদায় তালিকার ২০ নম্বর স্থানে রয়েছে কাঁচা ও শুকনো মরিচ। সেখানে প্রতি ৪০ কেজি (এক মণ) কাঁচা ও শুকনো মরিচের জন্য ৮টাকা খাজনা (টোল) পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে জোরপূর্বক অসহায় মানুষের কাছে খাজনা আদায় না করার জন্যও বলা হয়েছে। নির্ধারিত টোলের অতিরিক্ত টাকা উত্তোলন করা হলে, সেটা প্রতারণা এবং ফৌজদারী অপরাধের অন্তর্ভুক্ত হবে। এমন অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে সমস্ত দায়দায়িত্ব ইজারাদারের উপর ন্যস্ত হবে। সেই সাথে বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ফুলছড়ি উপজেলার কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ফুলছিড়ির এই মরিচের হাটটি উত্তরবঙ্গের মধ্যে প্রসিদ্ধ। বর্তমানে হাটটির বেহাল অবস্থা। প্রতি হাটে প্রায় ৪০০-৫০০ মরিচ চাষি ১৫০০ থেকে ২ হাজার মণ মরিচ বিক্রি করে থাকেন। প্রতিকূল আবহাওয়ায় ঝড়, বৃষ্টি এলে হাটে ক্রেতা, বিক্রেতাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। এত বড় একটি হাটে কোনো অবকাঠামো নেই বললেই চলে। একটি ছাউনি আছে, সেটাও অসমাপ্ত। ফলে প্রখর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাটে মরিচ বেচা-কেনা করতে হয়। খাজনাসহ বিভিন্ন খাতের অজুহাতে কৃষকের কাছে থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। অথচ এই হাট ইজারা দিয়ে সরকারের রাজস্ব বাবদ প্রতিবছর কোটি টাকা আয় হয়।
অভিযোগের বিষয়ে ইজারদারের প্রতিনিধি আলগীর হোসেন বলেন, ‘প্রতি হাটে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার মণ শুকনো মরিচ বিক্রি হয় এই হাটে।’ হাটের খাজনা বেশি নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা খাজনা নিচ্ছি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এরমধ্যে লেবার এবং পরিচ্ছন্ন কর্মীদের দিতে হয়।’
এ বছর কত টাকায় হাট ইজারা নিয়েছেন এবং প্রতি মণ মরিচে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কত টাকা খাজনা আদায় করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গত বছর ৯২ লাখ টাকা দিয়ে হাট ডেকে নিয়েছিলাম। এ বছর ১ কোটি ৭ লাখ টাকায় নিয়েছি। সরকারি ইজারা প্রতি মণ হয়তো ২২টাকা। বাকি টাকা লেবার এবং পরিচ্ছন্ন কর্মীদের দেওয়া হয়।’
সরকারের নির্ধারিত মূল্য ৪০ কেজি মরিচে মাত্র ৮ টাকা খাজনা আদায় করতে পারবেন, পাঁচগুণ বেশি খাজনা আদায় করছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সবাই বেশি নেয়, তাই আমরাও নেই।’
ফুলছড়ি হাটের মূল ইজারাদার অ্যাভভোকেট নুরুল আমিন বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি বাহিরে আছি। মরিচের মণ প্রতি সরকারি খাজনা মূল্য রশিদের মাধ্যমে পরিশোধ করেন বিক্রেতারা। তবে, মণ প্রতি কত টাকা খাজনা নেওয়ার সরকারি নির্দেশনা রয়েছে, তা না দেখে বলতে পারবো না। কেউ অতিরিক্ত অর্থ আদায় করলে আমার কাছে অভিযোগ দিতে বলুন, আমি ব্যবস্থা নেব।’
কাটা (ওজন) করতে প্রতি মণ শুকনো মরিচ থেকে এক কেজি মরিচ নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘হাটের সুইপাররা (পরিচ্ছন্ন কর্মী) এসব মরিচ নেয়। এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না।’
ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জগৎবন্ধু মন্ডল বলেন, ‘হাটে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করলে ইজারাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি ফুলছড়ি উপজেলায় নতুন যোগ দিয়েছি।’
হাটে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং বিক্রেতাদের জন্য আলাদা আলাদা ছাউনি না থাকার বিষয়টি দু:খজনক অবহিত করে তিনি বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গাইবান্ধা জেলা কৃষি বিপনন কর্মকর্তা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘চলতি বছর ১ হাজার ৯৯৫ হেক্টর জমিতে মরিচের চাষ হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় বেশি। নদী বেষ্টিত গাইবান্ধার ১৬৫ চরে এসব মরিচের চাষ হয়। শুধুমাত্র ফুলছড়িতেই ৬৫ ভাগ মরিচ উৎপাদন হচ্ছে। প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী বছর থেকে জেলার পাঁচ উপজেলায় কৃষি পণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে সরকার। তখন কৃষকের দুর্ভোগ কমবে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক কাজি নাহিদ রসুল জানান, অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের বিষয়টি তার জানা ছিল না। ওখানকার (ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) ইউএনও নতুন এসেছেন। তাই হয়তো তিনিও জানেন না। খোঁজ নিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাসুদ
আরো পড়ুন