বরগুনায় অবৈধ চুল্লিতে পুড়ছে কাঠ, বনবিভাগ চুপচাপ
ইমরান হোসেন, বরগুনা || রাইজিংবিডি.কম
কয়লা তৈরির চুল্লিতে অবাধে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে
বরগুনায় জনবসতি এলাকা অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কয়লা তৈরির চুল্লিতে অবাধে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এসব চুল্লিতে প্রতিদিন হাজার হাজার মণ সামাজিক ও সংরক্ষিত বনের কাঠ পুড়িয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে বনায়ন। এসব চুল্লির মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে রাজি নয় স্থানীয়রা। পরিবেশ কর্মীদের দাবি, বন বিভাগ ও চোরাকারবারিদের যোগসাজশে উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত ও সামাজিক বনের গাছ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনের কাঠ এভাবে উজাড় হতে থাকলে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
বলেশ্বর নদীর ওপারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি সুন্দরবন, এপারে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার দক্ষিণ কাঠালতলী গ্রাম। এ গ্রামে ৮টি মাটির চুল্লিতে সংরক্ষিত ও সামাজিক বনের কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করা হচ্ছে।
এ চুল্লির মালিক কাঠালতলী ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান সদস্য জাহাঙ্গীর হাওলাদার। তিনি গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংরক্ষিত ও সামাজিক বনের কাঠ পোড়াচ্ছেন।
চুল্লির মালিক জাহাঙ্গীর হাওলাদার রাইজিংবিডি-কে বলেন, ‘সবাইকে ম্যানেজ করে এই চুল্লি চালাচ্ছি। উপজেলা প্রশাসন জানে আমি অবৈধ চুল্লি চালাই। একবার আমাকে ডেকে নিষেধ করেছে। সেসময় আমি সব কিছু বুঝিয়ে বলার পরে আমাকে চালাতে বলেছে। তবে, স্যার আমাকে বলেছেন, উপর থেকে চাপ আসলে তার কিছু করার থাকবে না। তখন আমি বলেছি, স্যার উপর মহল থেকে চাপ আসলে আপনি আগে আমাকে বইলেন। স্যার বলেছেন, ঠিক আছে।’
এই উপজেলার রায়হানপুর ইউনিয়নের মাদারতলী এলাকায় ৫টি চুল্লি বসিয়ে বনের কাঠ পোড়াচ্ছেন ফজলু সরদার।
বরগুনা সদর উপজেলার আজগরকাঠি এলাকায় একইভাবে জনবসতি এলাকায় অবৈধভাবে কাঠ পুড়িয়ে বনায়ন ধ্বংস করছে। এখানে ৬টি মাটির চুল্লিতে কাঠ পোড়ানো হয়। স্থানীয় প্রভাবশালী কবির হোসেন এই চুল্লির মালিক।
এ এলাকার বাসিন্দা কহিনুর বেগম বলেন, এখানে দিনরাত কাঠ পোড়ায়। তার পরিবারের সকলে শ্বাস কষ্টে ভুগছেন। কবির হোসেন প্রভাবশালী লোক। তার বিরুদ্ধে কথা বললে সন্ত্রাসী দিয়ে রাতে ঘরবাড়িতে হামলা চালায়। তাই কেউ প্রতিবাদ করে না।
ওই এলাকার বাসিন্দা সজল, রাকিব, শাওন, দুলাল, জসিম মিয়াসহ কয়েকজন বলেন, ‘এখানে বার বার সাংবাদিকরা আসে রিপোর্ট করতে, আমরা তাদের সাক্ষাৎকার দেই। তবে, তারা কবিরের থেকে ঘুষ নিয়ে আর রিপোর্ট প্রচার করে না। প্রশাসনের লোকজন আসে। তারাও ঘুষ নিয়ে আর কোনো ব্যবস্থা নেয় না।’
উপকূলীয় সামাজিক ও প্রাকৃতিক বন রক্ষা কমিটির সভাপতি সুমন সিকদার বলেন, ‘কাঠ চোরাকারবারিদের সঙ্গে বন বিভাগের যোগসাজশে উপকূলজুড়ে বনায়ন ধ্বংস করার উৎসব চলছে। বন আইন আছে কিন্তু যারা আইন প্রয়োগ করবেন, তারাই যদি চোরাকারবারিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নেয়। তাহলে বন রক্ষা করবে কারা।’
পরিবেশ কর্মী সহিদুল ইসলাম স্বপ্ন বলেন, সুন্দরবন থেকে চোরাকারবারিরা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে এনে এসব চুল্লিতে বিক্রি করে। তালতলীর টেংরাগীরি সংরক্ষিত বনের গাছ প্রকাশ্যে কাটছে চোরাকারবারিরা। বন বিভাগ চুপচাপ। তাদের স্থানীয়রা তথ্য দিলেও বনের ভিতরে যায় না।
বরগুনা পলিটেকনিক কলেজের পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মঈন উদ্দিন আহমেদ রাইজিংবিডি-কে বলেন, বন রক্ষা করতে না পারলে কমবে অক্সিজেনের পরিমাণ, বৃদ্ধি পাবে তাপমাত্রা, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে হুমকিতে পড়বে জীববৈচিত্র্য। যার প্রমাণ দেশের মানুষ ইতোমধ্যে পেয়েছে। একটি দেশের আয়তনের ২৫ ভাগে গাছ থাকা দরকার হয়। বাংলাদেশে সেই সবুজায়ন নেই। দেশের বড় দুটি বন সুন্দরবন ও এরপর তালতলীর টেংরাগীরি বন। এই বন যদি উজাড় হতে থাকে তবে, তাপমাত্রা আরও বাড়বে। সামাজিক বনায়ন ধ্বংস করা হচ্ছে। সরকারের উচিৎ এসব দিকে নজর দেওয়া।
এ বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হয়নি বন বিভাগ। তবে অবৈধ এসব চুল্লি বন্ধ করে বনায়ন রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, অবৈধ এসব কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির চুল্লির তালিকা করার কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। এসব চুল্লির কারণে পরিবেশে বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। খুব কঠোরভাবে তাদের দমন করা হবে। শীঘ্র এ সব চুল্লি গুড়িয়ে দেওয়া হবে। এ সিন্ডিকেটের জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে ৪৫১ বর্গকিলোমিটার। এতে হুমকিতে পড়েছে বনজ-জলজ সম্পদ। তবে, কী পরিমাণ সামাজিক বনায়ন ধ্বংস করা হচ্ছে, তার সঠিক হিসাব সংশ্লিষ্ট কারও কাছে নেই।
/বকুল/