ঢাকা     রোববার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

গুজব: পার্বত্য অঞ্চলে রাসেল’স ভাইপার খাওয়ার প্রস্তুতি  

বান্দরবান প্রতিনিধি  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:১৩, ২৫ জুন ২০২৪   আপডেট: ২২:৪৮, ২৫ জুন ২০২৪
গুজব: পার্বত্য অঞ্চলে রাসেল’স ভাইপার খাওয়ার প্রস্তুতি  

রাসেল’স ভাইপার। ছবি: সংগৃহীত

দেশের বেশ কিছু জেলায় চন্দ্রবোড়া বা রাসেল’স ভাইপার সাপের উপদ্রব বেড়েছে। বহুল আলোচিত এই সাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মাধ্যম ফেসবুকে ‘বাস্তবেরও বেশি’ গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সম্প্রতি, এই সাপ ‘রান্না করে পার্বত্য অঞ্চলে খাওয়া হচ্ছে’— এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব। এমনকি, পার্বত্য অঞ্চলে রাসেল’স ভাইপারের অস্তিত্বও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

‘রাসেল’স ভাইপার নিয়ে পুরোদেশ যেখানে আতঙ্কে, সেখানে পার্বত্য এলাকায় রাসেল’স ভাইপার খাওয়ার জন্য রেডি’— ফেসবুকে এই গুজবটি শেয়ার করেন সিংথোয়াং মং মার্মা নামে এক নেটিজেন। ঘটনার সত্যতা জানতে চাইলে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বান্দরবানে রাসেল’স ভাইপার সাপ আছে কি না, সে বিষয়ে কেউ জানি না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্ট দেখতে পেয়ে দুষ্টুমির ছলে শেয়ার করেছি। যেখানে রাসেল’স ভাইপার নেই, সেখানে এই সাপ খাওয়ার রেসিপির তো প্রশ্নই উঠে না।’

ফেসবুকে যে গুজব ছড়ানো হয়েছে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে রাসেল’স ভাইপার নিয়ে ছড়ানো গুজবে লেখা হয়েছে— রাসেল’স ভাইপার সাপের মাথা কেটে গর্ত খুড়ে মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। এরপর সরু একটি বাঁশে পুরো সাপটি লম্বা করে গেঁথে চামড়া পুড়িয়ে নিয়ে নাড়িভুঁড়ি ফেলে প্রয়োজনমত ছোট ছোট পিস করে কেটে নিতে হবে। মাংস পরিষ্কার করে ধুয়ে নিয়ে এরপর পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, তেল, হলুদ, লবণ আর সাবারাং (এক ধরনের পাতা) মাখিয়ে বাঁশের চোঙায় ভরে সামান্য পরিমাণে পানি দিয়ে চুলায় অল্প আঁচে আধঘণ্টা থেকে ৪০ মিনিট রান্না করতে হবে। যাদের কাছে বাঁশের চোঙা নেই তারা পাতিলের তলায় অল্প একটু পানি দিয়ে তার ওপর কলাপাতা বিছিয়ে নিয়ে তাতে মাংস দিয়ে অল্প আঁচে রান্না করে নিতে পারেন। রান্না হয়ে গেলে সেটা বাটিতে অথবা কলাপাতায় ঢেলে নিতে হবে। 

ফটোকার্ড বানিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে

এদিকে, ২১ জুন এনজিওকর্মী সাঅং মার্মা নামে একজন ফেসবুকে এ-সংক্রান্ত পোস্ট শেয়ার করেন। সেখানে দেখা যায়, তার গলায় একটা নির্বিষ দাঁড়াশ সাপ পেঁচিয়ে ধরে আছে। অথচ ছবির ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন, ‘রাসেল’স ভাইপার প্লাস হলুদ পাতা চলবে’।

জানতে চাইলে সাঅং মার্মা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক জনগোষ্ঠীর মানুষ সাপ খায়। পাহাড়ি অঞ্চলে অনেক রকম বিষধর ও নির্বিষ সাপ দেখা যায়। তবে, রাসেল’স ভাইপার দেখা যায়নি। এটি নিয়ে দেশে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। সে কারণে অনেকেই ‘মজা করে’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়েছে।’’

বান্দরবানে আদিবাসী খাবারের দোকান শৈ শৈ ক্যাফের ব্যবস্থাপক নুংহ্লা মার্মা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পাহাড়ি হোটেলগুলোতে গুইসাপ নিয়মিত রান্না হয়। অন্যান্য সাপের চাহিদা কম থাকায় রান্না হয় না। যারা অন্যান্য জাতের সাপ খেয়ে থাকেন, তারাও এখন সাপ পেলে বাড়িতে রান্না করে খান।’ 

ফেসবুকে ছড়ানো গুজবের স্ত্রিনশট

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মংসিং হাই মার্মা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দেশের অন্যান্য জেলায় দেখা পেলেও পাহাড়ে রাসেল’স ভাইপার দেখা যায়নি। পাহাড়ি জনপদের মানুষ সাপের আতঙ্কে থাকে না। অনেক জনগোষ্ঠীর সাপ খাওয়া খাদ্যাভ্যাসে রয়েছে। ফলে পাহাড়ি এলাকায় সাপকেও অন্যান্য জীবজন্তুর মতই স্বাভাবিক মনে করেন। তবে, রাসেল’স ভাইপার এই অঞ্চলে খাওয়া হচ্ছে, এটা পুরোপুরি গুজব।’

বন বিভাগের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ শাখার ডেপুটি ফরেস্ট অফিসার (চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিএফও) রফিকুল ইসলাম চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এই বিষধর রাসেল’স ভাইপার সাপ দেশের বিভিন্ন  জেলায় ছড়িয়ে পড়লেও বান্দরবানে এখনও দেখা যায়নি। বান্দরবান যেহেতু পাহাড়ি এলাকা, সেখানে রাসেল’স ভাইপার সাপ থাকার সম্ভাবনা নেই। রাসেল’স ভাইপার ভাসমান প্রজাতির সাপ। নদীর তীরবর্তী এলাকা, স্যাঁতসেঁতে জায়গা, জলাশয়ে থাকা কচুরিপানা— এসব জায়গায় তাদের আবাসস্থল ও বংশবৃদ্ধির অন্যতম জায়গা। যার ফলে পাহাড়ি এলাকায় এই ধরনের সাপ নেই।’ 

বান্দরবান সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে হাবিবা মীরা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বান্দরবানে রাসেল’স ভাইপার সাপের সন্ধান মেলেনি। তাই সেভাবে সরকারি নির্দেশনাও নেই। যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কোথায় এই সাপ

১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের সাপ’ বইয়ে বন্য প্রাণিবিশেষজ্ঞ মো. আলী রেজা খান বলেছেন, চন্দ্রবোড়া সাপ রাজশাহী বিভাগে সর্বাধিক পাওয়া যায়। অন্যত্র আছে, তবে তেমন দেখা যায় না।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টার বলেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৯টি জেলায় চন্দ্রবোড়া সাপ দেখা গেছে। ২০১৮ সালে এই সাপ থাকা জেলার সংখ্যা বেড়ে হয় ১১টি। ২০২৩ সালে ২৩টি জেলায় এই সাপ নথিভুক্ত করেছিলেন ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষকেরা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে জেলার সংখ্যা আরও বাড়ে।

২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত ৩২টি জেলায় এই সাপ দেখা গেছে। জেলার তালিকায় আছে: নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট,  চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও বরগুনা।

পদ্মা নদী ও তার শাখা নদীর তীরবর্তী জেলাগুলোতে চন্দ্রবোড়ার বিস্তার সবচেয়ে বেশি বলে দাবি করেছে ভেনম রিসার্চ সেন্টার।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফজলে রাব্বি চৌধুরী সাপের বিষ নিয়ে গবেষণায় যুক্ত। তিনি জানান, এই সাপ ভালো সাঁতার কাটতে পারে। নদীপথে এই সাপ ছড়ায়। মেহেরপুর, চুয়াডঙ্গার মতো এলাকাতেও এই সাপ কীভাবে পৌঁছাচ্ছে, তা গবেষণার দাবি রাখে।

চন্দ্রবোড়া বাড়ছে কেন

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চন্দ্রবোড়া বা রাসেল’স ভাইপার সাপ কবে প্রথম দেখা গিয়েছিল, সেই ইতিহাস অজানা। তবে সাম্প্রতিক কালে এই সাপ কেন বাড়ছে, তার সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও পাওয়া যাচ্ছে না। বিএসএমএমইউ’র ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফজলে রাব্বি চৌধুরী জানান, গুইসাপ, বেজি, প্যাঁচা, চিল ও বাজপাখি— এদের শিকার ছিল চন্দ্রবোড়া। এখন গুইসাপ, বেজি, প্যাঁচা, চিল ও বাজপাখি কমে গেছে বা কোথাও কোথাও নাই বললেই চলে। প্রধান শত্রুগুলো কমে যাওয়াই চন্দ্রবোড়া বৃদ্ধির কারণ বলে আমরা মনে করছি। তবে আরও গভীর অনুসন্ধান দরকার।

চাইমং/এনএইচ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়