ঢাকা     সোমবার   ০১ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৭ ১৪৩১

মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস

দালালের কাছে গেলে সহজ, নিজে গেলে ভোগান্তি 

জাহিদুল হক চন্দন, মানিকগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪৩, ২৮ জুন ২০২৪   আপডেট: ২৩:০৯, ২৮ জুন ২০২৪
দালালের কাছে গেলে সহজ, নিজে গেলে ভোগান্তি 

মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস

কামরুজ্জামান বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইনসেপটার ধামরাইয়ের বারবাড়িয়া অফিসে চাকরি করেন। গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ হলেও বসবাস করেন মানিকগঞ্জের টিএনডি অফিসের পিছনে। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে পাসপোর্ট করতে নিজেই আবেদন করেছেন। ব্যাংকে টাকাও জমা দিয়েছেন। সকল প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস নিয়ে সোমবার (২৪ জুন) সকাল সাড়ে ৯টায় হাজির হন বেউথা এলাকায় অবস্থিত মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে। 

প্রথমদিকের সিরিয়ালে থেকেও অফিসের নিচ তলায় আবেদন জমা দেওয়ার রুম নম্বর ১০১ এর পাশে দাঁড়িয়ে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন। কাউন্টার থেকে বলা হয়েছে, তিনি যে একজন ইঞ্জিনিয়ার তার প্রমাণ দিতে হবে। কামরুজ্জামান সরকারি অথরাইজড থেকে প্রাপ্ত ইঞ্জিয়ারিং আইডি কার্ড কাউন্টারে প্রদর্শন করেন। তবুও মন গলে না কাউন্টারে থাকা কর্তার। তারপর তিনি কামরুজ্জামানের কাছে এইসএসসি পরীক্ষার কাগজপত্র চান।

এ ঘটনার প্রতিবাদে কামরুজ্জামান ওই কর্মকর্তাকে বলেন, ‘যেখানে অনার্স, মাস্টার্সের সকল ডকুমেন্টস আছে, সেখানে এইসএসসি সকল ডকুমেন্টস কি খুব প্রয়োজন?’ তর্ক বড় না করে তিনি সমস্ত ডকুমেন্টস এনে কাউন্টারে থাকা ব্যক্তিকে দেখানে। এ ঘটনার পর কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় কাউন্টারে আবেদন ফরম জমা দিতে সক্ষম হন। পরে ছবি তুলতে গেলে ১০৬ নম্বর রুমেও তাকে বেগ পেতে হয়। এ যাত্রায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা হয়রানির শিকার হয়ে পাসপোর্ট তৈরির সকল কাজ সম্পন্ন করেছেন তিনি। 

একইদিনে সিংগাইর উপজেলার শায়েস্তা ইউনিয়নের চর লক্ষ্মী গ্রামের আনোয়ারা বেগম নিজের মেয়ে দুই নাতি-পুতি নিয়ে এসেছেন পাসপোর্ট অফিসে। তার মেয়ের জামাই দেড় বছর ধরে ওমান থাকেন। সেখানে একটি দোকান দিয়েছেন, এখন বউ বাচ্চাকে সেখানে নিয়ে যেতে চান। তাই তিনজনের পাসপোর্ট করাতে এই অফিসে আসা। মেয়ের ১০ বছর মেয়াদের পাসপোর্ট, দুই নাতির ৫ বছর মেয়াদের পাসপোর্ট। কোনো রকম ঝামেলা ছাড়া তিনটি পাসপোর্ট পেতে তিনি দালালকে দিয়েছেন ২৩ হাজার টাকা। কাউন্টারে তাদের কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি, কোন বাড়তি কাগজপত্রও চাওয়া হয়নি। নির্বিঘ্নে আবেদন ফরম জমা দিয়ে যাবতীয় কাজ সেরেছেন তারা। 

এসব ঘটনা মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিত্যদিনের চিত্র। দালালদের মাধ্যমে চ্যানেল খরচ মিটিয়ে এলে কাউকে হয়রানি হতে হয় না। অপরদিকে নিজে সবকিছু করতে গেলেই এই ভুল, ওই ভুলের অজুহাতে হতে হয় হয়রানির শিকার। 

গত সোমবার (২৪ জুন), মঙ্গলবার (২৫ জুন) ও বুধবার (২৬ জুন) পাসপোর্ট অফিস ঘুরে ২৭ জন সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন এ প্রতিবেদক। তারমধ্যে ২১ জন হয়রানি এড়াতে দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট অফিসে এসেছেন। তাদের কাউকেই কোনো হয়রানির শিকার হতে হননি। বাকিদের মধ্যে চার জন দালালের মাধ্যমে না গিয়ে নিজেরাই চেষ্টা করেছেন। তাদের প্রত্যেককেই হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। আর বাকি দুই জনের ভিআইপি তকমা থাকায় তাদের কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি। 

একাধিক সেবাপ্রার্থীর ভাষ্যনুযায়ী, পাসপোর্ট অফিসের সামনেই গড়ে উঠেছে দোকানপাট। এসব দোকান থেকেই দালালরা ব্যবসায়িক তকমা ব্যবহার করে অফিসের লোকজনের সাথে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। যদিও তারা পেটের দায়ে এ কাজ করেন। কিন্তু অফিসের লোকজন ঘুষখোর না হলে তো আর দালালরা এসব কাজ করতেন না। তাই আগে অফিসের লোকজনের ঘুষ লেনদেন বন্ধ করা উচিত। সেইসাথে সেবাপ্রার্থীদের সাথে আচরণে মানবিক হওয়া উচিত। 

অনুসন্ধান বলছে, প্রতিটি পাসপোর্টে দালালদের গোপন কোড থাকে। যে কোডটিই প্রমাণ করে তিনি কোন দালালের মাধ্যমে এসেছেন। কাউন্টারে থাকা দায়িত্বরত ব্যক্তি থেকে শুরু করে ছবি তোলার দায়িত্বে থাকা কর্তা ব্যক্তিরা ওই কোড দেখেই বুঝে যান প্রার্থী কোন দালালের মাধ্যমে এসেছে। এ কারণে তারা কোনো হয়রানি করেন না। এরকম কোড ছাড়া আবেদন থাকলেই শুরু হয় হয়রানি। আর টুকটাক ভুল থাকলে হয়রানির মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ। 

যারা দালালদের ঘুষ দিয়ে চ্যানেল খরচ মিটিয়ে কাগজ জমা দেন, তাদের কোনো হয়রানি হতে হয় না। ফলে বেশিরভাগ সেবাপ্রার্থীর হয়রানি এড়াতে দালালকে ঘুষ নামক চ্যানেল খরচ দিয়ে পাসপোর্ট করিয়ে নেন। তবে অফিসে কর্মরত কেউ সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে সরাসরি টাকা নেন না। তারা শুধুমাত্র চিহ্নিত দালালদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে টাকা নেন। দালালের মাধ্যমে আসা প্রতিটি পাসপোর্টের ভাগের টাকা অফিসে থাকা টপ টু বটম প্রত্যেকের পকেটে নির্দিষ্ট হারে ঢোকে। 

পাসপোর্ট অফিস থেকে পাওয়া তথ্যমতে, এ অফিসে গড়ে প্রতিদিন ১২০টি থেকে ১৩০টি আবেদন জমা পড়ে। এরমধ্যে একশোটির বেশি পাসপোর্ট যায় দালাল চক্র হয়ে। প্রতিদিন পাসপোর্ট অফিসে ঘুষের টাকা ঢোকে প্রায় এক লাখ। 

সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে গত তিনদিনে পাসপোর্ট অফিসের সামনে নয়জন দালালের সাথে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। তারা জানান, পাসপোর্ট আবেদন থেকে শুরু করে ব্যাংক ড্রাফট পর্যন্ত সকল কাজ তারাই করে দেন। সরকারি খরচের বাইরে পাসপোর্ট প্রতি দুই থেকে তিন হাজার টাকা বেশি নেন। যার এক হাজার টাকা পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ বাবদ দিতে হয়। ফলে কোন ধরনের হয়রানি ছাড়াই মানুষ পাসপোর্ট করতে পারছেন। 

সুশাসনের জন্য নাগরিক মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি ইকবাল হোসেন কচি বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসের কর্তা ব্যক্তির হয়রানির এমন আচরণ জনমনে প্রভাব পড়ে। ফলে সকল কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও শুধুমাত্র হয়রানি এড়াতে সাধারণ মানুষ ঘুষ দিয়ে পাসপোর্ট করাচ্ছেন। ঊদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে নজরদারি না বাড়ানোর ফলে পাসপোর্ট অফিস এখনো দুর্নীতিমুক্ত হতে পারেনি। যারা এমন ঘুষ-দুর্নীতির সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

তবে স্টাফদের সঙ্গে দালাল চক্র বা অন্য কারোরই কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করেন মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক অরূপ রতন চাকী।

তিনি বলেন, ‘দালাল চক্রের সঙ্গে অফিসের স্টাফদের কোনো যোগসাজস নেই। যারা এই ধরনের কথা বলেন, তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। সরকারি অফিসের সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য সবসময় একটি চক্র কাজ করে থাকে। এসব তাদের ছড়ানো কথা।’

//সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়