ঢাকা     মঙ্গলবার   ০২ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৮ ১৪৩১

চলনবিলে অবাধে তৈরি হচ্ছে নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী জাল 

পাবনা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:১০, ৩০ জুন ২০২৪  
চলনবিলে অবাধে তৈরি হচ্ছে নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী জাল 

এভাবে অবাধে তৈরি করা হচ্ছে চায়না দুয়ারী জাল

বর্ষা মৌসুম শুরুর পর থেকে চলনবিলে, খালবিলে, নদী-নালায় ঢুকেছে নতুন পানি। বেড়েছে দেশি মাছের আনাগোনা। আর এ সুযোগে মৎস্য শিকারিরা নেমেছে এসব মাছ শিকারে। প্রতিদিন স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি হচ্ছে এ সব মাছ। বিশেষ করে ছোট মাছ ও পোনা মাছ বেশি বিক্রি হচ্ছে। 

এর মধ্যে চাহিদা বেড়েছে মাছ শিকারের বিভিন্ন উপকরণের। বেশি চাহিদা নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী জাল। তাই চলনবিলের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট কারখানায় অবাধে এসব চায়না দুয়ারী জাল তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে।

এমনই এক কারখানার সন্ধান মিলেছে পাবনার চাটমোহরে। উপজেলার বিলচলন ইউনিয়নের বোঁথর গ্রামে রয়েছে এ কারখানাটি। যেখানে দিনে দুপুরে প্রশাসনের নাকের ডগায় অবাধে তৈরি ও  বিক্রি হচ্ছে চায়না দুয়ারী জাল। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ‘মাছ ধরার উপকরণ প্রস্তুতকারক ও বিক্রয় প্রতিষ্ঠান’ ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে নির্বিঘ্নে নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের চেয়েও ক্ষতিকর চায়না দুয়ারী জাল তৈরি করছেন সুশান্ত হলদার নামের এক অসাধু ব্যবসায়ী।

সম্প্রতি বোঁথর চড়কবাড়ির পাশে অবস্থিত চায়না দুয়ারী জালের কারখানায় সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, কারখানার চারপাশ বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা। লোহার গেটের ভিতরে ঢুকতে চোখে পড়ে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এ জাল তৈরির বিভিন্ন উপকরণ। জালের মধ্যে প্রবেশ করানোর জন্য তৈরি করে রাখা চার কোণাকৃতির লোহার চিকন রডের ফ্রেম। রড ঢেকে দেওয়ার জন্য প্লাস্টিকের চিকন পাইপ। একটি কক্ষে স্তুপ করে রাখা রয়েছে বিপুল পরিমাণ নতুন জাল। পাশের শেডে ফ্রেমে তৈরি হচ্ছে চায়না দুয়ারী জাল।

এলাকাবাসী জানান, বেশ কিছু দিন যাবত এ বাড়িতে চায়না দুয়ারী জাল তৈরি হচ্ছে। বাইরের কাউকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয় না। নারী-পুরুষ কারিগররা আসে-যায়। এ বাড়িতে কী হচ্ছে তা এলাকার কেউ কেউ জানলেও অনেকে জানেন না।

কারখানার কর্মচারীরা জানান, দুই সপ্তাহ হলো এখানে চায়না দুয়ারী জাল তৈরি হচ্ছে। সকালে বিভিন্ন এলাকা থেকে কারিগররা আসেন জাল তৈরি করতে। তবে তাদের ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে বলেও জানান তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা গ্রামের কালিপদ হলদারের ছেলে সুশান্ত হলদার ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের জন্য চাটমোহরের ১১ নং বিলচলন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিথী ট্রেডার্সের নামে ২০৬ নং ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে বোঁথর গ্রামে চায়না দুয়ারী জালের এ কারখানা পরিচালনা করে আসছেন।

জলজ জীববৈচিত্রের জন্য চায়না দুয়ারী জাল বা মাছ ধরার এ ফাঁদ কারেন্ট জালের চেয়েও ক্ষতিকর। এ জাল সূক্ষাতিসুক্ষ্মভাবে মাছ আটকে রাখতে সক্ষম। জালের বুননে এক গিঁঠ থেকে আরেক গিঁঠের দূরত্ব খুব কম হওয়ায় মাছ বা অন্য কোনো ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী একবার এ জালের মধ্যে প্রবেশ করলে আর বের হতে পারে না। অন্য জালের চেয়ে কম পরিশ্রমে চায়না দুয়ারী জালে অধিক পরিমাণ মাছ পাওয়া যায়। ফলে এ এলাকার জেলেদের কাছে কদর বেড়েছে চায়না দুয়ারী জালের।

জেলেরা এখন মাছ ধরতে কারেন্ট জালের পরিবর্তে ঝুঁকছেন চায়না দুয়ারী জালের দিকে। উৎপাদন, বিক্রয়, বিপনন, ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও চাটমোহরের বিল, নদীগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার জাল পেতে মা ও পোনা মাছ নিধন করছেন অসাধু মৎসজীবীরা। ফলে ক্রমশই বিলুপ্ত হচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ। এ জালের ব্যবহার অব্যাহত থাকলে মাছের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষুদ্র জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার শংকা রয়েছে। জলজ জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়বে।

জানতে চাইলে বিলচলন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকতার হোসেন জানান,  সিথী ট্রেডার্সের নামে মাছ ধরার উপকরণ প্রস্তুতকারক ও বিক্রয় প্রতিষ্ঠান ট্রেড লাইসেন্সটি তার দেওয়া। তবে, মালিক সুশান্ত হলদার যে এই ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে চায়না দুয়ারী জাল তৈরি করছেন তা তার জানা নেই।

এ বিষয়ে সুশান্ত হলদার বলেন, ‘সব জায়গাতেই এভাবে টুকটাক কাজ চলছে। আমরাও একটু করছি। চাটমোহরের বোঁথড়ে একটা ছোট্ট জায়গায় শুরু করেছি। কেবল কাজ শেখাচ্ছি। সবাই তো আর কাজ জানে না। গত রোজার ঈদের আগে থেকে কারখানাটি চালু হয়েছে। ওখানে আমার ভায়রা প্রকাশ হালদার দেখাশোনা করছে।’ 

এই জাল নিষিদ্ধ জানেন কি-না ও প্রশাসন জানে কি-না এ বিষয়ে সুশান্ত হালদার বলেন, ‘নিষিদ্ধ কাজ জানি। তারপরও সবখানে করছে, তাই আমিও একটু করছি আর কি। এখন প্রশাসন যদি বলে করা যাবে না, তাহলে করব না।’ 

সুশান্ত হালদারের ভায়রা প্রকাশ হালদার বলেন, ‘১৫ দিন হলো চালু করেছি। প্রশাসন জানে না। গোপনে চালাচ্ছি। এখন আপনারা যদি নিষেধ করেন, তাহলে বন্ধ করে দেওয়া লাগবে, তাছাড়া তো উপায় নেই।’

চায়না দুয়ারী জালের কারখানার বিষয়টি চাটমোহর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহেদী হাসান শাকিল কে অবহিত করলে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

এ ব্যাপারে চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেদুয়ানুল হালিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

আর চাটমোহর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল মতিন বলেন, ‘চায়না দুয়ারী জাল তৈরি, ব্যবহার, বিপণন, পরিবহন নিষিদ্ধ। বোঁথরে চায়না দুয়ারী জালের কারখানা রয়েছে বিষয়টি আমার জানা নেই। যত দ্রুত সম্ভব ইউএনও মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলে অভিযান চালানো হবে।’
 

শাহীন/বকুল 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়