ঢাকা     রোববার   ০৭ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২৩ ১৪৩১

৩০০ বছরের পুরনো গ্রামটি গিলে খাচ্ছে মেঘনা

শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৪, ৪ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ১২:১৮, ৪ জুলাই ২০২৪
৩০০ বছরের পুরনো গ্রামটি গিলে খাচ্ছে মেঘনা

ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের (ছবি: রাইজিংবিডি)

‘ঠিকমত খাওন জোডেনা। নতুন কইরা ঘর করা, জায়গা কিনা, কোনোডার সামর্থ্য নাই। শেষ সম্বল ছিলো ভিটা-মাটিডা। এইডাও ভাইঙা যাইতাছে। খালি আমাগো ঘর না, ৩০০ বছরের পুরানো এই গ্রামটি একটু একটু করে গিলে খাচ্ছে মেঘনা।’

নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় উপজেলার নয়ানগর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম এসব কথা বলেন। 

স্থানীয়রা জানান, বর্ষার শুরুতে মেঘনা নদীতে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে বিলীন হয়েছে বেশ কয়েকটি বসত ভিটা। এছাড়া ভাঙন ঝুঁকিতে ওই এলাকার ৩০০ বছরের পুরনো মসজিদসহ অন্তত সাড়ে চার শতাধিক ঘর-বাড়ি।

গ্রাম ও ঐতিয্যবাহী মসজিদটি রক্ষায় দ্রুত স্থায়ী বাঁধ নির্মানের দাবি স্থানীয়দের।

বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সকালে নয়ানগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মেঘনা নদীর পাড়ের নয়ানগর শাহী জামে মসজিদের নিচ থেকে মাটি সরে কলাম বেরিয়ে এসেছে। মাটি সরে যাওয়ায় মসজিদ রক্ষা বাধের ব্লকসহ দেয়াল ধসে পড়েছে। 

স্থানীয়রা বরেন, বর্ষায় পানি বাড়লে ভাঙন অব্যহত থাকতে পারে। এতে যেকোনো সময় মসজিদটি নদীতে বিলীন হতে পারে। মসজিদ ধরে উত্তর দিকে এগুতেই দেখা যায়, কয়েকটি বসত-বাড়ি সুরক্ষা দেয়াল ভেঙে পড়েছে। বাড়ি-ঘরের নিচের মাটি সরে কয়েকটি এক পাশে হেলে আছে।

এ সময় ওই এলাকার ভাঙনের শিকার এবং স্থানীয় অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ৮-১০ বছর আগেও নয়ানগর মসজিদ থেকে ৪০০ মিটার পশ্চিমে ছিল মেঘনা নদী। নদী ও মসজিদের মাঝখানে ঘর-বাড়ি, ফসলি জমি ছিল। গত কয়েক বছর ধরে মেঘনার ভাঙনে মসজিদ থেকে উত্তর দিকে নয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকার বসত-ভিটা, জমিজমা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গত বর্ষায় ভাঙতে ভাঙতে সেটি মসজিদের কাছাকাছি এসে এসেছিলো। কয়েকদিন আগে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। শুরু হয় আকষ্মিক ভাঙন।  এতে নদী পাড়ের তারা মিয়া, জাহাঙ্গীর মাস্টার, রফিকুল ইসলামদের বসত ভিটা বিলীন হয়ে যায়। 

বাড়ির তলদেশের মাটি সরে পেয়ারা বেগম, আওয়াল গাজী, আজি লারীদের ঘর ভেঙে পড়েছে। ভেঙে গেছে বসত বাড়িরর সুরক্ষা দেয়াল। 

স্থানীয়রা বলেন, দুদিন নদীতে বেশি পানি ছিল, তাতেই এতো ক্ষতি। এবার বর্ষার আগে ভাঙন ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে পানি বাড়লে নয়ানগর গ্রামের মসজিদসহ সাড়ে চারশতাধিক বসত ভিটা নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে।

ভাঙনের শিকার হত দরিদ্র তারা মিয়া প্রধান। তিনি নয়ানগরের প্রয়াত আয়াত আলী প্রধানের ছেলে। বংশ পরম্পরায় এ এলাকায় বসবাস তার। তারা মিয়ার স্ত্রী, শারীরিক প্রতিবন্দ্বী এক ছেলে ও বিধবা এক মেয়ে, মেয়ের ঘরে এক নাতিকে নিয়ে তার সংসার। দুটি ছোট ভাঙা ঘরে থাকতেন তারা। অন্যের সাহায্যে সহযোগিতায় কোনো রকমে চলে তাদের সংসার। গত ২৮ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। এতে একটি ঘর নদীতে বিলীন হয়ে যায়।

তারা মিয়া প্রধান বলেন, বাপ-দাদার জমি-জমা চোখের সামনে ভাঙতে ভাঙতে শেষ হইলো।  

এর আগেও মেঘনার ভাঙনে ভিটে-মাটি হারান মো. আলী কাজী, মো. আরাফাতরা।

এদিন কথা হয় এ দুজনের সঙ্গে। তারা বলেন, আমাদের সামর্থ্য ছিল আমরা অন্যত্রে বাড়ি করে আছি। এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গরিব। দিন আনে দিন খায়। একবার কেউ ভাঙনের শিকার হলে মাথা গোজার ঠাঁইটুকুও হারাবে। তাই বাসিন্দাদের বসত-ভিটা, ঐতিয্যবাহী মসজিদ, একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং গ্রামটি রক্ষা করতে হলে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন আটকাতে হবে। মসজিদ থেকে উত্তর দিকে নয়ানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ীভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।

ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. মামুন বলেন, এলাকার ক্ষয়ক্ষতির ছবি তুলে ইউনিয়ন কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে। ৩০০ বছরের পুরনো এ গ্রামটি বাঁচাতে হলে বেড়িবাঁধের বিকল্প নেই।

ওই এলাকাটি পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়েছে বলে জানান গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কোহিনুর আক্তার। 

তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে ছয় জন ক্ষতিগ্রস্তের নাম পেয়েছি। তাদের ঢেউ টিন ও খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে। ওই এলাকার ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়েছে। 

ওই এলাকার ভাঙনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ভাঙন ঠেকাতে সেখানে জিওব্যাগ ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান মুন্সীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম।

এই কর্মকর্তা বলেন, স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তাদের কাজ শুরু করেছে। কমিটির তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো পাঠানো হবে। বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু করা হবে।

ঢাকা/ইভা 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়