ঢাকা     সোমবার   ০৮ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২৪ ১৪৩১

মতিন-সালাম হত্যাকাণ্ড: খুনের প্রতিশোধ নিতে খুন

মেহেদী হাসান শিয়াম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ৫ জুলাই ২০২৪  
মতিন-সালাম হত্যাকাণ্ড: খুনের প্রতিশোধ নিতে খুন

মতিন ও সালাম

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে সহযোগী মতিন আলীসহ আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদের সদস্য আব্দুস সালামকে খুন করেছেন দুর্বৃত্তরা। গত ২৭ জুন উপজেলার রানীহাটি কলেজ সংলগ্ন আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাছে খুন করা হয় তাদের। প্রতিশোধ নিতেই তাদের হত্যা করার অভিযোগ ওঠেছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে।

নিহত আওয়ামী লীগ নেতা শিবগঞ্জ উপজেলার নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও মো. এত্তাজ আলীর ছেলে। সহযোগী মতিন রানীহাটি-ফতেপুরের মৃত আব্দুল মান্নানের ছেলে মতিন আলী। তিনি হরিনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের বক্তব্য
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যেই ককটেল ফাটিয়ে ত্রাস সৃষ্টি ও গুলি করে দুজনকে হত্যা করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। প্রথমে ককটেল হামলায় গুরুতর জখম হয়ে মাটিতে পড়ে যান তারা। ওই সময় ২০ থেকে ২৫ রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা যায়। অস্ত্র দিয়েও তাদেরকে কুপানো হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী রহিম বাদশা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আব্দুস সালামসহ আমরা কয়েকজন বসেছিলাম। তখনই অতর্কিত হমলা চালায় ২০-২৫ জনের একটি দল। অন্ধকার হওয়ায় তাদের চেনা যায়নি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নয়ালাভাঙ্গা এলাকার একজন স্কুল শিক্ষক বলেন, ‘আগেও এ এলাকায় অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু এবারের মতো এত গুলির শব্দ শোনা যায়নি। সালাম ও মতিনকে গুলি করে হত্যার পর এলাকায় নতুন আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।’

নিহত আব্দুস সালামের বড় ভাই শরিফুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আশরাফ ও তার গুণ্ডাবাহিনী আমার ভাইকে হত্যার হুমকি দিত, সেটা এলাকার সবাই জানে। সেই আমার ভাইয়ের খুনি। আমরা আশরাফসহ অন্য হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

তবে ঘটনার পর থেকেই পলাতক আশরাফ আলী।  এজন্য তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

প্রতিশোধ নিতে খুন
শিবগঞ্জের নয়ালাভাঙ্গা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুটি পক্ষের তীব্র বিরোধ দীর্ঘদিনের। একটি পক্ষের নেতৃত্ব দিতেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সালাম। অন্যপক্ষের নেতৃত্বে দিয়ে আসছেন বিএনপি নেতা ও নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফ আলী। ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল দুপুরে ওই এলাকার বিএনপি নেতা ও ইউপি সদস্য আলম হোসেন ঝাপড়াকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তারপর থেকেই আরও তীব্র হতে থাকে ওই দুইপক্ষের বিরোধ। এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ, হামলা, মারধর লেগেই থাকত।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে নয়ালাভাঙ্গার একজন বৃদ্ধের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘আলম ঝাপড়া খুন হওয়ার পরেই দুইপক্ষের ককটেল বাজি লেগেই থাকতো। তখন থেকেই এলাকায় এক চাপা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এমনও সকাল হয়েছে দুইপক্ষের ককটেল বাজির আওয়াজে। এখানকার সবাই ধারণা করছেন প্রতিশোধ নিতেই খুন করা হয়েছে আব্দুস সালামকে।’

প্রশাসনের ‘দায়িত্বে অবহেলার’র অভিযোগ
সহযোগীসহ খুন হওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সালাম তার নিরপত্তাহীনতার কথা আগেই পুলিশকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ আব্দুস সালামের নিরাপত্তায় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন তার স্বজনরা।

আব্দুস সালামের স্ত্রী ফেরদৌসি বেগম বলেন, ‘প্রায়ই তাদেরকে হত্যার হুমকি দিতো দুর্বৃত্তরা। দফায় দফায় তাদের বাড়িতে হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। কয়েকবার তার স্বামীকেও হত্যার চেষ্টা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় পুলিশকে অবহিত করা হয়। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে সালামের নিরাপত্তার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ফেরদৌসি বেগম বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা আমাকেও ফোন করে বলত, তোর স্বামী আজ আর ফিরবে না। তাকে হত্যা করা হবে। সন্ত্রাসীরা চেষ্টাও চালিয়েছিল। এবার আর তাকে ফিরে পেলাম না। অনেকবার তাকে (আব্দুস সালামকে) বলেছি এলাকা ছেড়ে চলে যাবো। যদি এলাকা ছেড়ে চলে যেতাম তাহলে আজ তিনি বেঁচে থাকতেন।’

জোড়া খুনের মামলায় প্রধান আসামি আশরাফ
ঘটনার পরের দিন রাতে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সালামের দ্বিতীয় স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম বাদী হয়ে শিবগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় ৫২ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরও ২০-২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় বিএনপি নেতা ও নয়ালাভাঙ্গা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফুল হকের নাম রয়েছে। মামলায় তার স্ত্রীরও নাম রয়েছে।

এই ঘটনায় গ্রেপ্তার ৬
সহযোগীসহ আওয়ামী লীগ হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে মামলার প্রধান আসামির স্ত্রী ও মামলাটির দ্বিতীয় আসামিও গ্রেপ্তার হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- নয়ালাভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আশরাফ আলীর স্ত্রী আনোয়ারা বেগম আম্বিয়া, শিবগঞ্জের ঘোড়াপাখিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আশরাফুল হক, নয়ালাভাঙ্গা এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ বাবুল ঝাপড়া বাবু, মৃত কাবির আলীর ছেলে রুহুল আমীন ঝাপড়া, তাবজুল হোসেনের ছেলে আব্দুল মান্নান এবং আখতারুজ্জমানের ছেলে উসমান আলী।

আসামির দায় স্বীকার
মতিন আলী ও আব্দুস সালামকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার উসমান আলী নামে এক আসামি দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সোমবার (১ জুন) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুজ্জামান তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম বলেন, উসমান আলী আব্দুস সালামসহ জোড়া খুনের মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। গ্রেপ্তারের পর তিনি স্বেচ্ছায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

আশরাফের বিরুদ্ধে মামলার রেকর্ড
বিএনপি নেতা আশরাফের বিরুদ্ধে ২১টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে ক্রাইম ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সিডিএমএসে। সেখানে তার পরিচিতিতে উল্লেখ করা হয়েছে-ত্রাস-সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী, হত্যাকারী ও অন্যান্য মামলার আসামি। ২১ মামলার মধ্যে ১২টি বিস্ফোরক আইনের, ২টি হত্যা, ৩টি ছিনতাই, ২টি প্রতারণা, একটি মাদক ও আইনশৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটানোর অপরাধে দ্রুত বিচার আইনেও মামলা রয়েছে তার নামে।

উদ্ধার হয়নি হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র
চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের পর ৬ দিন পর হলেও হত্যায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। ওই কিলিং মিশনে ব্যবহার করা হয় ককটেল, চাইনিজ কুড়াল ও আগ্নেয়াস্ত্র। সন্ত্রাসীরা একটি চাইনিজ কুড়াল ফেলে যাওয়ায় সেটি ছাড়া আর কোনো অস্ত্র উদ্ধার হয়নি।

যা বলছে পুলিশ
শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘নয়ালাভাঙ্গা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুইপক্ষের দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে। একপক্ষের নেতৃত্ব দেন আব্দুস সালাম। এই বিরোধের জের ধরে তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’

পুলিশের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘কিছু ঘটলেই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা একটা কমন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এটাতে অভ্যস্ত। আমরা তাকে (আব্দুস সালাম) সব সময়ই নিরাপত্তা দিয়ে এসেছি।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহা. নূরুজ্জামান বলেন, ‘ঘটনার পর থেকেই পুলিশ তৎপর আছে। তবে এখনো হত্যায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা যায়নি। আমরা অস্ত্র উদ্ধার ও আসামি ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।’

/এসবি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়