ঢাকা     সোমবার   ০৮ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২৪ ১৪৩১

ভাঙছে শেরপুরের দুই নদী, বিলীন শতাধিক বাড়িঘর

শেরপুর প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:০৭, ৫ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ১৫:৫৫, ৫ জুলাই ২০২৪
ভাঙছে শেরপুরের দুই নদী, বিলীন শতাধিক বাড়িঘর

শেরপুর জেলার বুক চিরে বয়ে চলা যমুনার শাখা নদী দশানী ও ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা নদীর মিলনস্থল সদর উপজেলার কামারের চর ইউনিয়নের ৬নং চর এলাকায়। মাঝে মাঝে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় মিলনস্থলটি হয়ে ওঠে ভয়াবহ সর্বনাশা। 

প্রতিবছরের ন্যায় এবারও টানা বর্ষণে শেরপুরের ব্রহ্মপুত্র ও দশানী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্ষার শুরুতেই এসব নদীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে বাড়ি-ঘর, আবাদি জমি ও রাস্তাঘাট। 

গত দুই বছরে দশানী নদীর ভাঙনে ৬নং চর গ্রামের অনেক পরিবারের বসতভিটা, কবরস্থানসহ আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সমপরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়েছে ৭নং চরের মানুষ। অনেকের জায়গা-জমি নদীতে বিলীন হওয়ায় মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। গত বছর পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে কিছু জিও ব্যাগ ফেললেও মিলেনি স্থায়ী সমাধান। এলাকাবাসিরা বার বার জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসনকে জানিয়েও কাজ হয়নি। এবারও পুরোনো আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। 

স্থানীয়দের দাবি, পাইলিং করে স্থায়ীভাবে সমাধান করা হোক।

বৃহস্পতিবার (৫ জুলাই) সরেজমিনে ৬নং চর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত তিন দিনেই প্রায় দেড়শ মিটার এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সেই সাথে হারিয়ে গেছে অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশটি বাড়ি। একর একর আবাদী জমির সাথে নদীর পেটে গেছে সবজির বাগান ও ধানের বীজতলা। ভাঙনের মুখে পড়েছে ৬নং চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ ও দুটি মাদ্রাসা, পোস্ট অফিস, গ্রামের রাস্তা ও কবরস্থান। আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছে মানুষ। অনেকেই শঙ্কায় আছেন কখন তাদের বাড়িঘর ও জমি নদীগর্ভে চলে যায়।

অপরদিকে ৭নং চর এলাকায় দেখা যায়, গতবারের দেওয়া জিওব্যাগ ফেলা অংশে ভাঙন শুরু না হলেও তার আগে ও পরের এলাকায় শুরু হয়েছে ভাঙন। এতে চরম হুমকির মুখে রয়েছে এলাকার একমাত্র বাজার। এলাকার অধিকাংশ নদীতীরবর্তী মানুষের বাড়ি ৭ থেকে ৮ বার স্থান পরিবর্তন করেও মিলছে না প্রতিকার। 

এই এলাকার মানুষের দাবি, স্থায়ীভাবে সমাধান না করে শুধু লোক দেখানো সমাধান দিয়ে তাদের কোনো কাজে আসছে না। স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীদের বালি উত্তোলন ও অপরিকল্পিত নদী খননকেও এর কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন স্থানীয়রা।

৮০ বছরের বৃদ্ধ লুৎফর রহমান বলেন, আমাদের চার ভাইয়ের মোট ৬০ বিঘা জমি ছিলো। দুধে ভাতে ছিলো আমাদের সংসার। নদী আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। এখন আমাদের ঘর খুলে রেখেছি কিন্তু ঘর তোলার জায়গা পাচ্ছিনা। খুব কষ্টের মধ্যে আমাদের জীবন যাচ্ছে। এখন শেখ হাসিনাই আমাদের আশ্রয়দাতা।

জলিল মিয়া নামে এক যুবক বলেন, আমরা মোট ৭ বার বাড়ি স্থানান্তর করেছি। এবার আবার ভাঙনের কবলে পরেছি। এবার নতুন করে ঘর তোলার মতো আর নিজের জায়গা নেই। প্রতিবেশির জায়গাতে বাড়ি করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আবার ভাঙলে এলাকা ছেড়ে ঢাকা চলে যেতে হবে। আমাদের এ ছাড়া আর কোনো গতি নেই।

স্বামী হারা পঞ্চাশোর্ধ এক নারী বলেন, মাথার উপর স্বামী নেই। এখন তিন সন্তান নিয়ে পরের বাড়ি কাজ করে খাই। তিন বার বাড়ি পরিবর্তন করে এখন ঠাঁই নিয়েছি আমার ননদের ছেলের বাড়িতে। এখানেও কপালে সইলো না। এবার সেই বাড়িও ভেঙে গেল। এখন আর এলাকায় থাকাই হবে না। সরকার আমাদের দেখেনা।

ওই এলাকার প্রাক্তন মেম্বার সাইফুদ্দিন মন্ডল আক্ষেপ করে বলেন, এই নদীতে দুই বছর আগে আমার বাড়ি ভেঙে গেছে। অন্যের জমিতে বাড়ি করে আছি। এবারও আমার নতুন বাড়ির অর্ধেক ভেঙে গেছে। আমি এখন ভূমিহীন হয়ে গেছি। এই নদীর ভাঙন রোধ না করতে পারলে আমার মতো শত শত লোক ভূমিহীন হয়ে যাবে।

এ ব্যাপারে কামারের চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব হাবিবুর রহমান বলেন, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। একেকবার একেক এলাকায় তাণ্ডব চালাচ্ছে নদী। গত বছর ভাঙন শুরু হলে প্রশাসনের লোকজন এনে সরেজমিন পরিদর্শন করিয়েছি। পরে দুই জায়গায় ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিলো। এবার আবারও ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে আমি ইউএনও ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি। আশাকরি দ্রুত সময়ের মধ্যে হয়তো ব্যবস্থা নিবেন তারা।

শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, শেরপুরের বেশ কয়েকটি নদীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেগুলোর স্থায়ীভাবে সমাধানের জন্য আমরা ডিপিপি পাঠিয়েছি। আমরা নদীগুলোর ভাঙন এলাকার খোঁজখবর নিচ্ছি। বিষয়টি আমাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যে অবহিত করেছি। ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তারিকুল/টিপু

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়