ঢাকা     রোববার   ০৬ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২১ ১৪৩১

অধ্যক্ষ হিসেবে এমপিও পাচ্ছেন, চেয়ারম্যানের সম্মানীও নিচ্ছেন

রাজশাহী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ৭ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ২২:৫২, ৭ জুলাই ২০২৪
অধ্যক্ষ হিসেবে এমপিও পাচ্ছেন, চেয়ারম্যানের সম্মানীও নিচ্ছেন

গোগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের বাসিন্দারা নিদারুণ দুর্ভোগের মধ্যে আছেন। তারা যে কোনো কাজের জন্য গেলে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানের দেখা পান না। তিনি গোদাগাড়ীর প্রেমতলী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ। বেশিরভাগ সময় সেখানেই থাকেন। আবার তিনি ইউপি কার্যালয়ে গেলে কলেজের প্রশাসনিক কাজেও জটিলতা দেখা দেয়।

গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ডিগ্রী কলেজের উপাধ্যক্ষ থাকাকালে ২০১৬ সালে তিনি প্রথম গোগ্রাম ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ২০২১ সালে দ্বিতীয়বার ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছেন তিনি। সম্প্রতি তাকে প্রেমতলী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মজিবর রহমান গোগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। দলের উপজেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও তিনি। কলেজ-পরিষদ ছেড়ে অনেক সময় তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও ব্যস্ত থাকেন। ফলে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও দুর্ভোগের শিকার হন। আবার কলেজ শেষ করে অধ্যক্ষ মজিবর রহমান রাজশাহী নগরীর রানীবাজারের বাড়িতে ফিরে আসেন। ফলে ইউনিয়ন এলাকার গ্রামের মানুষ কোনো প্রয়োজনে তাঁকে খুঁজে পান না।

গত ১৫মে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। এতে ইউপি চেয়ারম্যানদের সরকার নির্ধারিত সময়ে অফিসে অবস্থান করে বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মজিবর রহমান ইউপি কার্যালয়ে থাকেন না বলে সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে এক ভুক্তভোগী রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। জেলা প্রশাসক এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছ থেকে একটি প্রতিবেদন নিয়েছেন। পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য এই প্রতিবেদনটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

গোগ্রাম ইউনিয়নের ফরাদপুর গ্রামের বাসিন্দা তসিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার স্ত্রী আসমা বেগমের জাতীয় পরিচয়পত্রে বাবার নাম ভুল আছে। এটি ঠিক করতে হলে আগে ইউনিয়ন পরিষদে জন্ম নিবন্ধন ঠিক করতে হবে। এই কাজের জন্য ১০-১২ দিন ঘুরেও চেয়ারম্যানের দেখা পাইনি। আমি ব্যবসায়ী মানুষ, কাজের ওপর থাকি। কতদিন যাওয়া যায়? ঘুরে ঘুরেও চেয়ারম্যানের দেখা না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি।’

বড়শিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবু বাক্কার বলেন, ‘বাড়ি থেকে ইউনিয়ন পরিষদে যাতায়াত করতে ২০০ টাকা করে খরচা হয়। কোনো কাজের জন্য গেলেই দেখি চেয়ারম্যান নাই। চেয়ারম্যানের দালালরা আছে। তারা টাকা নিয়ে কাজ করে। কিন্তু কিছু কিছু সময় তো চেয়ারম্যানকেই দরকার। সেই সময়টা আমরা তাকে পাই না। একটা লোক দলের সভাপতি, কলেজের প্রিন্সিপাল আবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। কোনদিক ছেড়ে কোনদিক ঠিক রাখবে? আমরা খুব দুর্ভোগে আছি।’

একই কথা বললেন ধাৎমা গ্রামের বাসিন্দা সেলিম মুলু। তিনি বলেন, ‘শুনি যে চেয়ারম্যান ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সম্মানী নেন আবার অধ্যক্ষ হিসেবেও বেতন-ভাতা নেন। কিন্তু তিনি কোনো কাজই ঠিকভাবে করেন না। ২০১৬ সালে যখন প্রথমবার চেয়ারম্যান হন, তখনও দুই জায়গা থেকেই বেতন-ভাতা তুলেছেন। কিন্তু মানুষকে সেবা দেননি। এভাবে তো চলতে পারে না।’

মজিবর রহমান যে একইসঙ্গে চেয়ারম্যান ও অধ্যক্ষ হিসেবে বেতনভাতা নেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে কাগজপত্রে। গত ৮ এপ্রিল ইউএনও আতিকুল ইসলাম উপজেলার সব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সম্মানী ভাতার চেক ছাড় করেন। ওই চিঠিতে গোগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের জন্য ১ লাখ ২১ হাজার ৫০০ টাকার চেক ছাড় করা হয়। আবার প্রেমতলী ডিগ্রি কলেজের গত মে মাসের মাসিক পে অর্ডারে (এমপিও) অধ্যক্ষ হিসেবে মজিবর রহমানের ব্যাংক হিসাবে বেতন-ভাতা দেওয়ার তথ্য রয়েছে। অধ্যক্ষ ও ইউপি চেয়ারম্যান মজিবর রহমান নিজেও দুই জায়গা থেকে বেতন-ভাতা গ্রহণের কথা স্বীকারও করেছেন।

মজিবর রহমান বলেন, ‘কলেজ থেকে আমি বেতন-ভাতা নিই। আর ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও সম্মানী নিই। সেটা নেওয়া যায়। প্রথমবার আমি যখন চেয়ারম্যান ছিলাম, তখনও নিয়েছি। কোনো সমস্যা হয়নি।’ 

পরিষদে না থাকার কারণে নাগরিক দুর্ভোগ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সকালে আমি কলেজে যাই। কলেজ সেরে বিকালে পরিষদে আসি। গ্রামের মানুষ দুপুরের পর থেকেই পরিষদে আসে। কারও কোনো হয়রানি হয় না। তারপরও সরকার একটা পরিপত্র দিয়েছে যে, পুরোটা সময় পরিষদে অফিস করতে হবে। কিন্তু সারাদেশে এ রকম অনেক চেয়ারম্যান আছেন যারা শিক্ষক। তারা এটা পারবেন না। আমাদের বিষয়ে আলাদা সিদ্ধান্ত দিতে হবে।’

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগ পেয়ে আমরা গোদাগাড়ীর ইউএনওর কাছে প্রতিবেদন চেয়েছিলাম। তিনি প্রতিবেদন দিয়েছেন। এখন করণীয় নির্ধারণে প্রতিবেদনটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক ড. বিশ্বজিৎ ব্যানার্জী বলেন, ‘বেসরকারি চাকরির বিধিমালায় আছে কেউ একইসঙ্গে দুই জায়গা থেকে বেতন-ভাতা বা সম্মানী নিতে পারবেন না। কেউ এটা নিয়ে থাকলে ফেরত দিতে হবে। মজিবর রহমানের বিষয়টি মৌখিকভাবে শুনেছি। কেউ আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নেব। তাকে যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে। একইসঙ্গে অধ্যক্ষ ও ইউপি চেয়ারম্যান থাকতে পারবেন না।’

কেয়া/সনি


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়