বগুড়ায় রথযাত্রা
উৎসব পরিণত হলো বিষাদে, আয়োজকদের দুষছে প্রশাসন
বগুড়া প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
বিভিন্ন এলাকার সনাতন ধর্মালম্বীরা রথযাত্রায় অংশ নেন
বগুড়া জেলা শহরে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে রোববার (৭ জুলাই) ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও অনেকে। কিন্তু কি কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটলো? কার ভুলে এত মানুষের প্রাণ গেলো-এসব নিয়েই এই প্রতিবেদন।
ঘটনার শুরু
প্রতি বছরের মতো এবারও বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি ইসকন মন্দির থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা বের হয়। বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান, জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বিকেল ৫টার দিকে রথযাত্রার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পরে সেউজগাড়ি পালপাড়া এলাকা থেকে রথযাত্রা নিয়ে কয়েক হাজার পুণ্যার্থী বের হন।
রথটি আমতলা সেউজগাড়ী মোড়ে স্টেশন রোডে ওঠার পর রথের মাস্তুলের সঙ্গে ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের সংযোগ ঘটে যায়। এতে মুহূর্তেই রথের সঙ্গে থাকা অসংখ্য পুণ্যার্থী বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়েন।
রথযাত্রায় অংশগ্রহণকারী কয়েকজন জানান, যে রাস্তা দিয়ে রথটি যাচ্ছিলো তার উপরের ছিল সেই বিদ্যুতের তার। রথের মাথা বিদ্যুতের তারে লাগার সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে ওঠে। চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। কেউ কিছু বোঝার আগেই নারী-পুরুষ-শিশু মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
এ সময় লোকজন দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। পরে আবার তারা রথের কাছে এসে মাটিতে পড়া থাকা লোকজনকে উদ্ধার করেন। কিছু মানুষ তখন রথটি টেনে বনানী শিব মন্দিরের দিকে চলে যায়।
যা বললেন প্রত্যক্ষদর্শী
রথযাত্রা শুরুর পর মোবাইলে ছবি তুলছিলেন অজয় পাল নামের এক ভক্ত-পুণ্যার্থী। কয়েকটি ছবি তোলার পর মোবাইলের ক্যামেরায় আগুন দেখতে পান। এরপর আশপাশে তাকিয়ে দেখেন কেউ নেই। হঠাৎ ওপর থেকে তার ছিঁড়ে পড়লে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি। কাছে গিয়ে দেখেন, রথের আশপাশে অসংখ্য মানুষ পড়ে আছেন। বগুড়ায় রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টের দুর্ঘটনার বর্ণনা এভাবেই করছিলেন তিনি।
অজয় পাল বলেন, ‘রথ থেকে মাত্র ১৫-২০ হাত দূরে ছিলাম। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের পর আগুন ধরে যাওয়ার ঘটনায় অনেকের শরীর ঝলসে গেছে। ’
রথযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন বগুড়া শহর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি পরিমল প্রসাদ। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রায় ১৫ হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের অংশগ্রহণে রথযাত্রা পুলিশ লাইনসসংলগ্ন মন্দিরের উদ্দেশে রওনা করে। ১০ মিনিটের মাথায় রথযাত্রা শহরের সেউজগাড়ি আমতলা মোড়ে পৌঁছালে রথের চূড়ার সঙ্গে রাস্তার ওপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শ লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তার ও রথের চূড়ায় আগুন ধরে যায়। বিদ্যুতায়িত হন রথ ধরে থাকা অর্ধশতাধিক রথযাত্রী। প্রাণ বাঁচাতে হুড়োহুড়ি, ছোটাছুটিতে পদদলিত হয়ে আহত হয়েছেন অনেকেই।’
সতর্ক করার পরও মানা হয়নি রথের উচ্চতা
বগুড়া শহরের রাস্তার ওপর দিয়ে বৈদ্যুতিক তার থাকায় রথের চূড়ার উচ্চতা আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছিল প্রশাসন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথযাত্রা আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, সড়কে বৈদ্যুতিক তারের অবস্থান ভেদে রথের চূড়া ওঠানামা করা হবে। কিন্তু তা মানা হয়নি। যে কারণে রথের চূড়ার সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার লেগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বছরে দুই দফা রথযাত্রা ও উল্টোরথযাত্রা বের হয়। শহরের রাস্তার ওপরে থাকা বৈদ্যুতিক তারের অবস্থান অনুযায়ী ঠিক কত ফুট উচ্চতায় রথ ওঠানো যাবে, তা আয়োজকদের আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের সেই সতর্কতা সত্ত্বেও ২৫ ফুট উচ্চতায় রথের চূড়া ওঠানো হয়।
আয়োজকদের দুষছে প্রশাসন
জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এটি আয়োজকদের ভুলে নিছক দুর্ঘটনা। তবুও দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং বিদ্যুৎ বিভাগ ও পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) পি এম ইমরুল কায়েস। কমিটিকে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
আয়োজকদের বক্তব্য
রথযাত্রা উৎসব আয়োজক কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি (অধ্যক্ষ) খরাজিতা কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘বহুকাল থেকে বগুড়া শহরে রথযাত্রা ও উল্টোরথযাত্রা উৎসব হয়ে আসছে। অতীতে কখনো এ রকম মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেনি। রথযাত্রার সবকিছু দেখভাল করতে কমিটির পক্ষ থেকে ১০০ জন সেবক নিয়োগ ছিল। সড়কের ওপর বৈদ্যুতিক তারে যাতে রথের স্পর্শ না লাগে, এজন্য রথের চূড়া ওঠানো-নামানোর জন্য দুজনকে দায়িত্ব দেওয়া ছিল। আমতলা মোড়ে ভুলক্রমে রথের চূড়া নিচে নামানোর আগেই বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শ লেগে আগুন ধরে যায়। রথে হাত রাখা সবাই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। চূড়া ওঠানো-নামানোর দায়িত্বে থাকা অলোক কুমার ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন।
কেউ শোনেনি কথা
ইসকন বগুড়া শাখার অধ্যক্ষ খরাজিতা কৃষ্ণদাস বলেছেন, ‘ঘটনার আগে রথযাত্রায় প্রচুর ভিড় ছিল। আমি বারবার গম্বুজটি নামাতে বলেছি। কিন্তু, আমার কথা কেউ শোনেনি। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আমিও পড়ে গেছি। এরপর আর কিছু জানি না। সড়কে তার থাকবেই। তারের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় রথের গম্বুজটি নামানোর কথা ছিল। এজন্য আমাদের লোকজনও ছিল।
নিহত ৫ ব্যক্তি
নিহতরা হলেন-সারিয়াকান্দী উপজেলার সাহাপাড়ার বাসিন্দা বাসুদেবের স্ত্রী সবিতা (৪০), আদমদীঘি উপজেলার কন্দুগ্রাম থানার ভবানী মোহন্তের ছেলে নরেশ মোহন্ত (৬০), পুরান বগুড়ার হিন্দু পাড়ার বাসিন্দা ননী কেশর সরকারের স্ত্রী অতসি রানী সরকার (৪৫), সদর উপজেলার গোহাইল মাসিন্দা এলাকার বাসিন্দা সুদেব মোহন্তের স্ত্রী রঞ্জিতা মোহন্ত (৫৫) এবং ছোট বেলঘড়িয়া এলাকার মৃত নরেন্দ্রনাথের ছেলে অলক কুমার (৪০)।
পড়ুন
বগুড়ায় রথযাত্রায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ৫ জনের মৃত্যু, আহত ৪০
বগুড়ায় রথযাত্রায় দুর্ঘটনা, প্রত্যক্ষদর্শী যা জানালেন
/এনাম/সাইফ/