মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস
ফাঁকফোকরে ঘুষ লেনদেন, ভোগান্তিই নিয়তি
জাহিদুল হক চন্দন, মানিকগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
ছবি: রাইজিংবিডি
মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক), জেলা প্রশাসনের, র্যাব ও পুলিশের অভিযানেও বন্ধ হয় না ঘুষ লেনদেন। ফাঁকফোকর দিয়ে অফিসের অসাধু কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে দালাল চক্রের ঘুষ লেনদেন চলে। অফিসের কর্মকর্তাদের লোভ এবং প্রশাসনের পোক্ত নজরদারির অভাবে দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। ফলে দালাল ছাড়া পাসপোর্ট করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে।
অনুসন্ধান বলছে , দালালরা প্রতি পাসপোর্ট থেকে এক হাজার টাকা করে অফিসে দেন। গড়ে প্রতিদিন ১২০টি আবেদন জমা পড়ে। অন্তত ১০০টির মতো পাসপোর্ট থেকে ঘুষ বাবদ অফিস আদায় করে প্রায় এক লাখ টাকা। সরকারি বিভিন্ন ছুটিজনিত কারণে মাস শেষে গড়ে টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ লাখে। সেই হিসাবে এ অফিসে বছরে দালালদের কাছ থেকে দুই কোটি টাকার বেশি ঘুষ বাবদ আদায় হয়। এ টাকা পাসপোর্ট অফিসের টপ টু বটম অসাধু কর্তা ব্যক্তিদের পকেটে নির্দিষ্ট হারে বণ্টন হয়ে যায়।
সুশীল সমাজের দাবি, পাসপোর্ট অফিসের কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের সম্পদের হিসাব বিবরণী নিয়ে দুদক অভিযান পরিচালনা করলেই থলের বিড়াল বের হয়ে যাবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে বছরে প্রায় ২৫ হাজার আবেদন জমা হয়। এসব আবেদকারীদের সেবা সহজ করার জন্য এ অফিসে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। শুরুর দিকে ভাড়া ভবনে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা হলেও পরে শহরের বেউথা এলাকায় নিজস্ব ভবনে সেবা কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল মানিকগঞ্জসহ নয়টি জেলার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেবার মান আরও সহজ করতে ২০২০ সালের ১৯ মার্চ ই-পাসপোর্ট সেবা উদ্বোধন করেন ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সাইদুর রহমান খান।
গত অর্ধযুগে মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের অবকাঠামো থেকে শুরু করে ই-পাসপোর্ট সেবায় উন্নতি হলেও ভোগান্তি এবং হয়রানি কোনোটাই কমেনি। সেবাপ্রার্থীদের নানাভাবে হয়রানির ফলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই পাসপোর্ট করতে আসা সাধারণ মানুষ ভোগান্তি এড়াতে দালালদের দারস্থ হচ্ছেন। এ অফিসের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সরকারি বিভিন্ন প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা পর্যন্ত ক্ষুব্ধ। বিভিন্ন সময় নানা ফোরামে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
২০১৭ সালের ৯ জুলাই মানিকগঞ্জে অনুষ্ঠিত আইন শৃঙ্খলা সভায় ওই সময়ের পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান পাসপোর্ট অফিসের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরেন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সভায় তিনি বলেন, ‘পাসপোর্ট করতে কোনো গ্রাহক ফরম পূরণ করে জমা দিলে অফিসের কর্মকর্তারা বিভিন্ন অজুহাতে তা বাতিল বলে জানিয়ে দেন। ফলে গ্রাহকদের অফিসের একশ্রেণির দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে ফরম পূরণ করে নিতে হয়। প্রতিটি পাসপোর্ট বাবদ ৯০০ টাকা করে উৎকোচ নেন কর্মকর্তারা। আমার কাছে সুনির্দিষ্ট একাধিক অভিযোগ আছে।’
তবে ওই সভায় পাসপোর্ট অফিসের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। এমন অভিযোগের পরেও সুদিন ফেরেনি পাসপোর্ট অফিসে। এর তিন বছর পর ই-পাসপোর্ট সেবা চালু হয়। তবে সেবা না বেড়ে বেড়ে যায় উৎকোচের পরিমাণ। ৯০০ থেকে বেড়ে হয়ে গেছে এক হাজার। একসময় দালালেরা সরাসরি অফিসে প্রবেশ করেই কাজ করতেন। তবে ভবনটি সিসি ক্যামেরায় আওতায় আসার পর থেকে অফিসের ভেতর দালালদের আনাগোনা কমে গেছে। বাইরে থেকে মোবাইল ফোনে অফিসের অসাধু কর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে কাজ করেন দালালরা। এছাড়া ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে কাজ করতে পাসপোর্ট অফিসের বাইরে ৩০টির মতো কম্পিউটারের দোকান গড়ে উঠেছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালিত হলে কয়েকদিন দালালদের আনাগোনা ও অফিস কর্তাদের হয়রানি বন্ধ থাকে। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তা আবার চালু হয় পূর্ণবেগে।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে জেলা প্রশাসনের এক সভায় পাসপোর্ট অফিসসহ সকল সরকারি অফিসের প্রতারক চক্রের দৌরাত্ম বন্ধে জনসাধারনকে সচেতন করতে উপজেলা ও ইউনিয়নভিত্তিক মাইকিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া পাসপোর্ট অফিসের সামনে অবস্থিত কম্পিউটার কম্পোজ/ফটোকপির দোকানে পাসপোর্টের প্রতারকচক্র বিরোধী অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পাসপোর্ট অফিসে অভিযান পরিচালনা করে তিন দালালকে আটক করেন। পরে এ ঘটনায় সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া ২০১৯ সালের ৪ জুন সদর থানা পুলিশের অভিযানে ৮ জন দালাল আটক হন। পরে তাদের ভ্রাম্যমান আদালতের বিচারক তিন মাস করে কারাদণ্ড প্রদান করেন। ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর র্যাবের সহায়তায় জেলা প্রশাসন পাসপোর্ট অফিসের সামনে থেকে ১০ জন দালালকে আটক করেন। আটক ব্যক্তিরা তাদের দোষ স্বীকার করে নেওয়ায় ৭ দালালকে সাতদিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং বাকি তিনজনের অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
২০২৪ সালের ২৫ মার্চ এ পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি এনফোর্সমেন্ট টিম ছদ্মবেশে অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় আনসার সদস্যদের সরকারি ফির বাইরে লেনেদেনের সংশ্লিষ্টটা পায় দুদক টিম। এছাড়া অফিসের কর্মচারিদের সাথে দালালদের যোগসাজশের প্রাথমিক তথ্য পায়। এর আগে ২০১৯ সালে মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেন দুদক।
জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল রাইজিংবিডিতে ২০২১ সালের ১৫ জানুয়ারি ‘আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে হয়রানি, দালালেই মুক্তি’; ২০২২ সালের ১৭ মে ‘মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস: দালালদের খপ্পরে সেবাপ্রার্থীরা’ এবং ২০২৪ সালের ২৮ জুন ‘দালালের কাছে গেলে সহজ, নিজে গেলে ভোগান্তি’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ২০২১ সালে প্রতিবেদন প্রকাশের পর আনসার সদস্য ছাঁটাই, ২০২২ সালে প্রতিবেদন প্রকাশের পর অফিসের কর্মচারিদের বদলী করা হয়। তবে ২০২৪ সালের প্রতিবেদন প্রকাশের পর কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সহকারী পরিচালকের কাছে জানতে চাইলে তা তিনি জানাননি।
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ইন্তাজ উদ্দিন বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসের অনিয়ম বন্ধে অন্য দপ্তরগুলোর অভিযানে শুধুমাত্র দালাল চক্র ধরা পড়ে। আইনের ফাঁক ফোকরে বেরিয়ে এসে আবার তারা এসব কাজ শুরু করে। পাসপোর্ট অফিসের সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারিদের বিরুদ্ধে তেমন অভিযান পরিচালিত হয় না। আর হলেও দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তিও হয় না। ফলে অনিয়মের চর্চা বন্ধ হচ্ছে না। গণমাধ্যমে তাদের ঘুষ লেনদেনের ফন্দিফিকির ফাঁস হলে ঘুষ লেনদেনের অন্য একটি সিস্টেম আবিষ্কার করেন। ফলে ঘুষ গ্রহণের পদ্ধতি পরিবর্তন হলেও সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কোনো সমাধান হয় না।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক ( সুজন) মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সহসভাপতি ইকবাল হোসেন কচি বলেন, বেশিরভাগ আবেদনের সাথে সংযুক্তি দেওয়া কাগজপত্রে টুকটাক ভুল থাকে। সাধারণভাবে গেলে ওই আবেদন গ্রহণ করেন না পাসপোর্ট অফিসের কর্তারা। তবে দালাল ধরে গেলে এই টুকটাক ভুল মাফ হয়ে যায়। ফলে প্রক্রিয়াগতভাবে হয়রানি এড়াতে মানুষ দালালের স্মরণাপন্ন হচ্ছেন। এই বার্তা এখন গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে শতভাগ কাগজপত্র ঠিক থাকলেও ভোগান্তির ভয়ে দালালের কাছেই যাচ্ছেন সবাই। প্রশাসনের অভিযানে সাধারণ মানুষের এই ভয় কিছুটা দূর হলেও কয়েক দিন পরেই অফিস কর্তারা আবার হয়রানি করে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছেন। এই ভয়কে পুঁজি করেই অসাধু কর্তা ব্যক্তিরা তাদের পকেট ভরছেন। তবে যারা এমন অনিয়ম করছেন শাস্তি হিসেবে তাদের যদি চাকরি চলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতো তাহলে আবার অসাধুরা ভয়ে ঘুষ লেনেদেন ছেড়ে দিতেন। তবে সেটা হয়ই না, বড়জোড় তাদের বদলী হয়।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অফিসের একাংশ সরাসরি দালাল চক্রের সাথে জড়িত থাকার কারণে এমন সিন্ডিকেট গড় ওঠে। প্রশাসনের অভিযান শুধুমাত্র দালাল নির্মূলে সীমাবদ্ধ না রেখে যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারি জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা না গেলে এ হয়রানি বন্ধ হবে না।’
এদিকে, মানিকগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক অরুপ রতন চাকী পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি দমন কমিশনের অভিযানের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে, তাঁর কাছে এ সংক্রান্ত কোনো নথিপত্র বা কোনো তথ্য নেই বলে জানান।
‘আপনার অফিস পুরোপুরি দুর্নীতি মুক্ত করতে পেরেছেন কিনা’ এমন প্রশ্নে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এ কথা কি কেউ বলে?’
পাসপোর্ট অফিস পরিদর্শন করা হয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক রেহানা আকতার বলেন, ‘অফিসের পরিবেশ অনেক ভালো। ফ্রন্ট ডেস্কে সেবাপ্রার্থীদের ভুল-ত্রুটি ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। কেউ বাইরে আবেদন করতে গিয়ে কিছু করলে সে বিষয়ে কিছু করার থাকে না। তারপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
/সনি/