ঢাকা     রোববার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

চাকরি দেওয়ার পরিবর্তে ৩ যুবককে হত্যা করেন কনক: পুলিশ

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:২৪, ১৭ জুলাই ২০২৪  
চাকরি দেওয়ার পরিবর্তে ৩ যুবককে হত্যা করেন কনক: পুলিশ

তিন যুবককে সেনাবাহিনীতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ২৪ লাখ টাকা নিয়েছিলেন চাকুরিচ্যুত সেনা সদস্য মো. কনক। চাকরি দিতে না পারায় এবং টাকা যাতে ফেরত দিতে না হয় সেজন্য তিন জনকেই হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। পরে তাদের হত্যা করে লাশ গুম করেন কনক। বুধবার (১৭ জুলাই) সন্ধ্যায় নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একথা জানান টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মো. গোলাম সবুর।

এদিকে,  অভিযুক্ত কনক টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। অতিরিক্ত সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজ উদ্দিন ফরাজি কনকের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠান আদালত।

অভিযুক্ত কনক টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার মুশুদ্দি দক্ষিণ পাড়া গ্রামের তালেব আলীর ছেলে। তিনি ঢাকা সেনানিবাসে সৈনিক পদে কর্মরত ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

মারা যাওয়া তিন যুবক হলেন- টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার রসুলপুর গ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে সামাদ সজিব (১৮), গোপালপুর উপজেলার মজিদপুর গ্রামের নাসিম উদ্দিনের ছেলে আতিক হাসান (১৮) এবং জামালপুর সদর উপজেলার জুনায়েদপাড়া গ্রামের ঠান্ডা মিয়ার ছেলে মো. রাহাদ হোসেন ওরফে উজ্জল (১৮)।

এদের মধ্যে সামাদ সজিবের লাশ গত ১ ফেব্রুয়ারি বাসাইল উপজেলার পাটখাগুড়ি গ্রামের ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে একটি ভুট্টা খেত থেকে উদ্ধার করা হয়। আতিক হাসানের লাশ গত ৩ মার্চ উদ্ধার করা হয় মধুপুর গড় এলাকার একটি আনারস বাগান থেকে। রাহাত হোসেন উজ্জলের লাশ গত ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধু সেতুপর পূর্ব প্রান্তের সংযোগ সড়কের পাশে মীরহামজানি গ্রামের একটি বালুর স্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয় । 

তিন লাশ উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। মামলায় নাম না জানা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। পরিচয় না পাওয়ায় পুলিশ তিনটি লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করে। তিনটি মামলাই এখন তদন্ত করছে টাঙ্গাইল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার গোলাম সবুর বলেন, নিহত তিন যুবককে সেনাবাহিনীতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা করে নেন কনক। চাকরি দিতে না পারায় এবং টাকা যাতে ফেরত দিতে না হয় সেজন্য যুবকদের হত্যা করে লাশ গুমের পরিকল্পনা করেন তিনি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘাটাইলের সামাদ সজিবকে চাকরিতে যোগদানের কথা বলে গত ৩১ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শহরের আটপুকুর এলাকার বাসায় ডেকে আনেন কনক। একজনের সহযোগিতায় রাতে শ্বাসরোধে সামাদ সজিবকে হত্যা করেন তিনি। 

হত্যার পর মোটরসাইকেলের মধ্যে সামাদ সজিবের মরদেহ হেলমেট পড়িয়ে ওঠান কনক। মরদেহ নিয়ে ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের বাসাইল উপজেলার পাটখাগুড়ি গ্রামে একটি ভুট্টা খেতে নিয়ে ফেলে দেন তিনি। পরে মোটরসাইকেল থেকে পেট্রোল ঢেলে সামাদ সজিবের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাসাইল থানার পুলিশ গত ৪ ফেব্রুয়ারি মরদেহ উদ্ধার করে। পরে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে।

একইভাবে গত ২ মার্চ গোপালপুরের মজিদপুর গ্রামের আতিক হাসানকে কনক ও তার সহযোগি মধুপুর গড় এলাকার পীরগাছা রাবার বাগান এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে স্থানীয় এক পাহাড়ি ব্যক্তির বাড়িতে তারা মদ্পান করেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে আতিক হাসানকে পার্শ্ববর্তী একটি আনারস বাগানে নিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন তারা। পরে মোটরসাইকেল থেকে পেট্রোল নিয়ে এবং শুকনা পাতা দিয়ে মরদেহ ঢেকে তাতে আগুন ধরিয়ে দেন আসামিরা। পরদিন মধুপুর থানা পুলিশ নাম না জানা মরদেহ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় হত্যা মামলা করা হয়। এই মামলাতেও নাম না জানা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। 

পরদিন ৩ মার্চ রাহাত হোসেন ওরফে উজ্জলকে হত্যা করেন কনক। এর আগে চাকরিতে যোগদানের কথা বলে রাহাতের বাবার কাছে খবর পাঠায় কনক। রাহাতের বাবা টাঙ্গাইল শহর বাইপাস এলাকায় এসে কনকের কাছে রাহাতকে দিয়ে যান। কনক ও তার সহযোগি রাহাতকে নিয়ে যায় শহরের আটপুকুর এলাকার ভাড়া বাসায়। সেখানে রাহাতকে গলাটিপে হত্যা করেন তারা। পরে রাহাতের মরদেহ হেলমেট পড়িয়ে মোটরসাইকেলে বসিয়ে নিয়ে যায় বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপ্রান্তের সংযোগ সড়কে। সেখানে রাস্তার পাশে চারলেন কাজের জন্য রক্ষিত বালুর স্তূপের নিচে রাহতের মরদেহ চাপা দিয়ে রাখেন তারা। গত ১২ মার্চ রাহাতের গলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।  এ ঘটনাতেও পুলিশ বাদী হয়ে নাম না জানা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করে। মামলাটি পিবিআই তদন্ত করছে।

পুলিশ সুপার আরও বলেন, তিন যুবকের খোঁজ না পেয়ে তাদের পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি সেনা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে। এ ঘটনায় কনক চাকরিচ্যুত হয়।
এদিকে সামাদ সজিবের বাবা বাদী হয়ে কনকসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইল আদালতে মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে গত ১ জুন মামলাটি ঘাটাইল থানায় তালিকাভুক্ত করা হয়। নিহত আতিক হাসানের বাবা বাদী হয়ে কনকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে গোপালপুর থানায় গত ২১ জুন মামলা করেন। রাহাত উজ্জলের বাবা বাদী হয়ে কনকের বিরুদ্ধে গত ১৪ এপ্রিল মামলা করেন জামালপুর সদর থানায়।

ঘাটাইল থানায় দায়েরকৃত মামলাটি তদন্তকালে পুলিশ জানতে পারে, জামালপুর সদর থানায় দায়েরকৃত মামলায় কনক কিছুদিন আগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি জামালপুর কারাগারে আটক আছেন। 

পুলিশ সুপার গোলাম সবুর বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে কনক জানিয়েছেন, তিনি চাকরি দেওয়ার কথা বলে যে ২৪ লাখ টাকা নিয়েছিলেন, তার মধ্যে ৯ লাখ টাকা তার সহযোগিকে দিয়েছেন। বাকি টাকা তিনি অনলাইনে জুয়া খেলে হেরেছেন।

ঘাটাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু ছালাম মিয়া বলেন, ‌‘আদালতের মাধ্যমে আসামি কনককে ঘাটাইল থানায় সামাদ সজিবের বাবার দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে রিমান্ড চেয়ে গত মঙ্গলবার আদালতে আবেদন করা হয়। আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘মঙ্গলবার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় কনক তিন যুবককে হত্যার কথা স্বীকার করেন। তিনি এক সহযোগির নামও বলেছেন। পরে তিনি আদালতে জবানবন্দি দিতে সম্মত হন। আজ টাঙ্গাইল জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাকে হাজির করা হয়। তিনি তিনটি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেন।’

কাওছার/মাসুদ


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়