ঢাকা     রোববার   ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  ভাদ্র ২৪ ১৪৩১

পঁচনে বিড়ম্বনা, ভালো বীজের অভাবে রংপুরে কমছে পাট চাষ

আমিরুল ইসলাম, রংপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৯, ২৬ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ০৮:৩০, ২৬ জুলাই ২০২৪
পঁচনে বিড়ম্বনা, ভালো বীজের অভাবে রংপুরে কমছে পাট চাষ

ছবি: রাইজিংবিডি

রংপুরে বর্ষা মৌসুমে খাল-বিলে স্থায়ীভাবে পানি না থাকায় পাট পঁচনে অনেক বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় চাষিদের। পাট কেটে জমিতেই ফেলে রাখতে হয় দিনের পর দিন। এরপর অপেক্ষা করতে হয় বৃষ্টির পানিতে খাল-বিল ভরলে সেখানে পাট পঁচাবেন। এছাড়াও উন্নত মানের বীজ, খরচের তুলনায় ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা ও পাটজাত শিল্প কলকারখানা গড়ে না ওঠায় প্রতিবছর রংপুর অঞ্চলে পাট চাষাবাদে আগ্রহ কমছে কৃষকদের।

রংপুর কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে রংপুর জেলায় পাট চাষাবাদ হয়েছে ৯ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে। যেখানে গত বছর পাট চাষ হয়েছিলো ৯ হাজার ৭৬৮ হেক্টর আর ২০২২ সালে সেটি ছিলো ১০ হাজার ৫৮ হেক্টরে। অর্থাৎ তিন বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিবছর দুই থেকে ৪শ হেক্টর করে পাট চাষাবাদ কমছে রংপুরে।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারীতে ২০২৩ সালে প্রায় ৭০ হাজার কৃষক ৫১ হাজার ৬২৭ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করেছিলো। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে চাষের জমির পরিমাণ ছিলো ৫৬ হাজার ৪১২ হেক্টরে। এই পরিসংখ্যান গত ১০ বছরে নিয়ে গেলে দাঁড়াবে এই অঞ্চলে পাট চাষ কমেছে অন্তত ৪০ শতাংশ। আর ২০ বছরের পরিসংখ্যান করলে দেখা যাবে এ অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে পাট চাষ কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। 

রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর, কূর্শা ও পীরগাছা উপজেলার শরিফ সুন্দর, বড়দরগা এলাকার পাট চাষি জিল্লাল, ইসমাইল, বাবু রাম, গৌরাঙ্গের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, প্রতি বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে পাট চাষ করতে তাদের খরচ হয় ১২-১৫ হাজার টাকা। আর ওই জমিতে পাট উৎপাদন হয় পাঁচ-ছয় মণ। বাজারে সবচেয়ে ভালো পাটের মণ বিক্রি হয় সর্বোচ্চ দুই হাজার থেকে দুই হাজার দুইশত টাকা। যদিও এই দামে পাট খুবই কম বিক্রি হয়। তার পরেও এই হিসাবে প্রতি বিঘায় চাষ করে অন্তত ২ থেকে ৪ হাজার টাকা লোকসান হয় তাদের। তবে চার মাসের কঠোর পরিশ্রমে ফলনের পরিমাণ আরও ভালো হলে চাষিদের লাভ-লোকসান সমান অথবা এক-দুই হাজার টাকা আয় হতে পারে বলেও জানান তারা।

এছাড়াও এক সময়ে বিস্তীর্ণ মাঠে দোল খাওয়া সবুজ পাট কোথায় হারিয়ে গেলো, কেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন? এসব প্রশ্নের জবাবে চাষিরা জানিয়েছেন, ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, বীজ সংকট, শ্রমিকের বাড়তি মজুরি, চাষে খরচ বেশি, জাগ দিতে ভোগান্তি, পানির সংকট ও কৃষি বিভাগের উদাসীনতার কারণে চাষাবাদ ছেড়েছেন তারা।

চাষিরা আরও জানান, প্রতি বিঘায় পাট চাষে খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা। ফলন তুলতে সময় লাগে তিন থেকে চার মাস। এই তিন-চার মাস পরিশ্রমের পর এক বিঘায় পাওয়া যায় ১০-১২ হাজার টাকার পাট। বাকিটা লোকসান দিতে হয়। পরিপক্ব বীজ পেতে ভোগান্তি পোহাতে হয় দিনের পর দিন। একেক প্রতিষ্ঠান একেক বছর একেক ধরনের বীজ বিক্রি করে। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের বীজের প্যাকেটে ১০ শতাংশ অপরিপক্ব থাকে। এখানে কৃষি বিভাগের গাফিলতি রয়েছে। পাশাপাশি বর্তমান সময়ে কৃষি শ্রমিকের বেশি মজুরি চাষাবাদে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১০ বছর আগে শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ছিলো ১৫০-২০০ টাকা। তখন পাটের মণ বিক্রি হতো ৮০০ টাকায়। বর্তমানে শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে পাঁচ গুণ। পাটের দাম হয়েছে দ্বিগুণ। বাজারে দুই হাজার টাকায় পাটের মণ বিক্রি করতে হয়।

এছাড়া পর্যাপ্ত পানি না থাকায় জাগ দিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। বাধ্য হয়ে খাল-বিল বা নদীতে জাগ দিতে হয়। সেখানেও বেড়েছে খরচ। এতো কিছুর পর বাজারে নিয়ে গেলে ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায় না। তবে কৃষি বিভাগ ধানের মতো পাটের দাম নির্ধারণ করে দিলে এবং মাঠ থেকে সংগ্রহ করলে লাভবান হতেন চাষিরা। সেটি করা গেলে আবারও সোনালি আঁশ পাটের সুদিন ফিরে আসতো বলেও দাবি তাদের।

প্রতি বছর রংপুরে পাটের চাষাবাদ কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে জেলা পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা মাহবুব আলম বলেন, অনাবৃষ্টির কারণে কৃষকরা পাট পঁচাতে পারছেন না। ‘রিবন রোটিং’ পদ্ধতিতে পাট পঁচানোর জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এক সময় সমতলে প্রচুর পরিমাণে পাট চাষ হতো। এখন সেসব জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদন করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। এ কারণে পাট চাষ এখন মূলত পরিত্যক্ত জমি ও চর এলাকায় হচ্ছে। যার কারণে উৎপাদনও কিছুটা কমছে। তবে উন্নত জাতের পাট চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি পাট চাষিদের বিনামূল্যে উন্নত মানের বীজ, দানাদার সার সরবরাহ করাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে প্রদর্শনী প্লট তৈরি করে আগ্রহ ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন জানান, চলতি মৌসুমে রংপুর জেলায় ৯ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৫৩০ বেল পাট। গত দুই বছর থেকে চাষিরা পাটে ভালো দাম পাচ্ছে। তবে এই অঞ্চলে পাট পঁচনে পানির ব্যাপক সঙ্কট দেখা দেয়। যার ফলে পাট কেটে জাগ দেওয়া নিয়ে বিরম্বনায় পরে চাষিরা। এতে করে অনেক চাষি পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তবে কৃষি বিভাগ ও পাট অধিদপ্তর যৌথ উদ্যোগে ‘রিবন রোটিং’ পদ্ধতিতে পাট পঁচনের বিষয়ে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এছাড়াও পাট চাষে কৃষকদের নানাভাবে পরামর্শ দেওয়াসহ বিনামূল্যে বীজ সার দেওয়া হচ্ছে।

রংপুর জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসান বলেন, এই অঞ্চলে পাটের সুদিন ফেরাতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পাটজাত শিল্প কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনাসহ পাটশিল্পকে অন্যতম রপ্তানি খাতে পরিণত করতেও কাজ করছে সরকার।

/ইমন/

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়