ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘আমার পোলারে যারা মারছে, তাদের বিচার আল্লাহ করবো’

নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৩, ২৭ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ১৮:২৩, ২৭ জুলাই ২০২৪
‘আমার পোলারে যারা মারছে, তাদের বিচার আল্লাহ করবো’

নিহত জাকির হোসেন (বাঁ থেকে প্রথম)

সকাল থেকেই মনটা ছটফট করছিল চার সন্তানের জননী মোমেনা বেগমের (৫৫)। দুপুরে মনের মধ্যে অজানা ঝড় ওঠে। বিপদের আশঙ্কায় ফোন দেন নাড়িছেঁড়া ধন বড় ছেলে জাকির হোসেনকে। ‘বাবা তুমি এখন কোথায়?’ জানতে চাইলে অফিসেই আছে বলে মাকে জানান জাকির। 

ছেলেকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন, ‘বাবা আজ তুমি কোথাও বের হবা না। তোমার বড় রকমের বিপদ হবে।’ ছেলে মাকে কোথাও বের না হওয়ার ‘মিথ্যা’ আশ্বাস দিয়ে কথা বলতে বলতেই গুলিবিদ্ধ হন। লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। ফোনে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় মুহূর্তেই। মায়ের আর বুঝতে বাকি থাকে না ছেলের বড় ধরনের বিপদ হয়েছে। ছেলে হারিয়ে পাগলপ্রায় মোমেনা বেগম বিলাপ করে কথাগুলো বলছিলেন।

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা বারিষাব ইউনিয়নের চরদুর্লভখা গ্রামের দরিদ্র কৃষক মো. সামাদের ছেলে তরুণ উদ্যোক্তা জাকির হোসেন গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) বেলা আড়াইটার সময় রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন বলে তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর মৃত্যু হয় তার।

মা মোমেলা খাতুন বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘ও আমার বাবা তুই আমারে ছাইড়া কোথায় গেলি! আমি যদি সেই সময় থাকতাম, আমি পুলিশকে কইতাম আমারে মারো, আমার পোলারে মাইরো না। আমার পোলারে যারা মারছে তাদের বিচার আল্লাহ করবো।’

নিহত জাকির হোসেনের বাবা আ. সামাদ জানান, ভিটে-মাটিসহ সর্ব সাকুল্যে দেড় বিঘার মতো জমি রয়েছে তার। অভাবের সংসারে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটছিল। বাবার কষ্ট লাঘব করতে এসএসসি পাশের পর ২০০৩ সালে তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন জাকির হোসেন। কঠোর পরিশ্রম আর মেধার পরিচয় দিয়ে কয়েক বছর আগে সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পান গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায়। 

আ. সামাদ আরও জানান, ছয় মাস আগে এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে ছোট পরিসরে ‘কাজী ভিআইপি গার্মেন্টস’ নামে একটি পোশাক তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন তিনি। শুক্রবার (১৯ জুলাই) দুপুরে কারখানার জন্য গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকা থেকে জরুরি কিছু মালামাল কেনে। পরে একজন বায়ারের ফোন পেয়ে তার সাথে দেখা করতে উত্তরা এলাকায় যাচ্ছিল। পথে আব্দুল্লাহপুর এলাকায় গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে অন্য গাড়িতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিল সে। সে সময় সেখানে পুলিশ ও জনতার ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। হঠাৎ করে পরপর দুটি গুলি তার পিঠে ও পেটে লাগে। সেসময় মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিল সে। 

মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে উত্তরার বাংলাদেশ আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার (২০ জুলাই) ভোর চারটার সময় তার মৃত্যু হয়। রোববার (২১ জুলাই) রাত দশটার দিকে জানাযা শেষে তাকে পারিবারিক কবর স্থানে দাফন করা হয় বলে জানান জাকিরের বাবা আ. সামাদ।

নিহত জাকিরের আব্দুর রহমান (৬) ও  বায়জিদ(২) নামে দুটি ছেলে রয়েছে। অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা স্ত্রী জান্নাতুন নাঈম। ছেলেদের নিয়ে কীভাবে সংসার চালাবেন, কীভাবে বাচ্চাদের বড় করে তুলবেন, ভবিষ্যৎ কী হবে এসব চিন্তায় কোনো কূল কিনারা পাচ্ছেন না তিনি। স্বামী হত্যার বিচার চান জান্নাতুন নাঈম। 

তিনি বলেন, ‘গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকালের খাবার খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে যান তিনি। সারাদিন অফিসে থাকবেন বলে জানিয়েছিলেন। সারাদিন আর তার সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি। বিকেল পাঁচটার দিকে তার অফিসের কয়েকজন লোক বাসায় আসেন। তাদের কাছে উনার কথা জিজ্ঞাসা করলে তারা প্রথমে কোনো জবাব দেননি। পরে তারা জানান, আমার স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।’

গাজীপুর সদর উপজেলার ভীম বাজার এলাকায় ‘কাজী ভি আই পি গার্মেন্টস’ নামের একটি ছোট্ট কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন জাকির হোসেন। 

ওই কারখানার কর্মকর্তা কামরুল জানান, জাকির গার্মেন্টস কারখানার কাজের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। একসময় তিনি এসব কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন। তার এলাকার সাইফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি ছোট আকারের একটি গার্মেন্টস কারখানা গড়ে তোলেন। সেখানে জাকির হোসেনকে তিনি পুরো কারখানার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। নিজের কারখানার প্রয়োজনে উত্তরায় গিয়ে জীবন দিতে হলো জাকিরকে।

রেজাউল করিম/সনি

ঘটনাপ্রবাহ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়