সহিংসতা-পরবর্তী কারফিউ
লোকসানে বগুড়ার দই-মিষ্টি ব্যবসায়ীরা
এনাম আহমেদ, বগুড়া || রাইজিংবিডি.কম

কারফিউ চলাকালে ৫০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করতে পারেননি বগুড়ার দই-মিষ্টি ব্যবসায়ীরা
সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেওয়ায় কয়েক দিন ধরে সারাদেশে চলছে কারফিউ। এ সময় প্রায় ৫০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করতে পারেননি বগুড়ার দই ও মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারী ও ব্যবসায়ীরা। এখন কারফিউ শিথিল হলেও ক্রেতা সঙ্কট এবং কখন কী সিদ্ধান্ত আসবে, এমন জটিলতায় ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারছেন না তারা। ফলে, লোকসানের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। দই এবং মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারী একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে, দই ও মিষ্টি উৎপাদন বন্ধ থাকার সময় দুধ বিক্রেতাদেরও লোকসান গুনতে হয়েছে। ক্রেতা না থাকায় প্রায় অর্ধেক দামে দুধ বিক্রি করেছেন তারা।
বগুড়া শহরসহ গোটা জেলায় দই উৎপাদনকারী ছোট-বড় ৪০০টি কারখানা এবং ৫০০টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে দইয়ের জন্য প্রসিদ্ধ এশিয়া সুইটস, চিনিপাতা, আকবরিয়া, শ্যামলী সুইটস, রফাত দই ঘর, মহরম দই ঘর, শেরপুর দই ঘর, গৌর গোপাল প্রভৃতি। দই-মিষ্টির এসব প্রতিষ্ঠান শহরের সাতমাথা এলাকাজুড়ে রয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই সাতমাথা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এর পর এসব দোকানসহ সাতমাথার সব মার্কেট বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন খুললেও আবার ১৮ তারিখে শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউনের দিনে সকাল থেকেই সাতমাথাসহ শহরের বিভিন্ন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দিনভর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ চলে। এরপর পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হলে কারফিউ জারি করা হয়। ফলে, দই- মিষ্টির ব্যবসাসহ সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে।
এশিয়া সুইটসের ব্যবস্থাপক আরিফ-উজ্জামান বলেছেন, কারফিউতে ২১ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত এই তিন দিন আমাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এর আগে আমরা ভোর ৬টা থেকে বেলা সাড়ে ১০টা-১১টা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে পেরেছি। হঠাৎ মিছিল আসার পর আমাদের প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিয়েছি। ওই সময় আমাদের দই- মিষ্টিগুলো বিক্রি করতে না পারায় জামিল মাদ্রাসা ও আমাদের কারখানার আশপাশের গরিব মানুষদের মাঝে বিলি করে দেওয়া হয়েছে। পরিমাণটা অনেক বেশি ছিল। ব্যবসার উদ্দেশ্যে খাবারগুলো তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু, শোরুমই যখন বন্ধ রাখতে হবে, আর এই খাবারগুলো তো পচনশীল, সে কারণে খাবারগুলো বিলি করা হয়েছে। কারফিউ’র আগে আমাদের ১ হাজার ৫০ পিস দই, ৭৩৫ কেজি মিষ্টি, ১৪০ কেজি স্পেশাল মিষ্টি বিক্রি করতে পারিনি। এগুলোর দাম আনুমানিক ৬ লাখ টাকার মতো। যে তিন দিন বন্ধ ছিল ওই সময় তো কোনো খাবার উৎপাদন করা হয়নি। আমাদের প্রতিদিনের যে বিক্রি, সেটাও বন্ধ ছিল। দই-মিষ্টি তৈরিতে আমাদের প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ৬০ মণ দুধ লাগে, সেটা লাগেনি। তবে, আমাদের স্টাফ স্যালারি এবং স্টাফ-কারিগরদের জন্য যে তিনবেলার খাবার, এগুলো তো দিতে হয়েছে।
রফাত দই ঘরের পরিচালক নুরুল ইসলাম দুলাল জানান, গত ১৬ জুলাই দুপুর থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। প্রতিদিন দই এবং বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি তৈরিতে তার প্রতিষ্ঠানে গড়ে ১৫ মণ দুধের প্রয়োজন পড়ে। এই ৯ দিন তার কারখানা এবং প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রতিদিন যে বিক্রি হতো, সেটা করতে পারেননি।
তিনি বলেন, আমার শুধু কর্মচারী বেতন লোকসান গেছে। আমার প্রতিষ্ঠানে কারিগরসহ মোট ১৫ জন স্টাফ রয়েছে। এই স্টাফদের বেতনসহ আরো আনুষাঙ্গিক খরচ মিলিয়ে আমার দিনে ২০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। তিন দিন আগে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়েছে। তবে, বেচা-বিক্রি আগের মতো নেই। মানুষদের মধ্যে আনন্দ নেই। লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে।
বগুড়া চেম্বারের পরিচালক ও আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল বলেন, আন্দোলন এবং কারফিউ’র কারণে গত কয়েকদিনে অন্তত ৫০ লাখ টাকার দই-মিষ্টি বিক্রি করতে পারিনি। পুরো বগুড়া জেলায় অন্তত ৪০-৫০ কোটি টাকার দই-মিষ্টি বিক্রি হতো, সেটা হয়নি। দুধওয়ালারা দুধ ফেলে দিয়েছে। দাম পায়নি।
তিনি বলেন, বর্তমানে লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। এ কারণে শহরে লোকজন কম। আমাদের এখন ব্যবসা নেই। আমরা দোকান খুলছি। তবে, কত পরিমাণ মাল বানাবো, কী পরিমাণ কাস্টমার আসবে আর কখন কারফিউ আসতেছে, কখন নতুন নির্দেশনা আসতেছে, এই ধরনের ভেজালের মধ্যে পড়ে গেছি। আসলে ঠিকমতো আমরা কেউ ব্যবসা করতে পারছি না। আমাদের প্রচুর পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে। আমাদের আকবরিয়া গ্রুপে ১ হাজারের মতো কর্মচারী রয়েছে। তাদের তিনবেলা খাবার দেওয়া, বেতন—সব মিলিয়ে বড় অ্যামাউন্ট চলে গেছে।
চিনিপাতা দইঘরের পরিচালক মুক্তার আলী বলেন, কারফিউ’র আগে আমাদের প্রস্তুত করা দই-মিষ্টিতে প্রায় ৪ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। বিক্রি করতে না পেরে সেগুলো বিনাপয়সায় বিলিয়ে দিয়েছি। কারফিউ শিথিল হয়েছে, কিন্তু একেবারে উঠে যায়নি। যে কারণে মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা নেই। আমাদের এই ব্যবসাটা লোক সমাগমের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু, মানুষ তো এখন আর সেভাবে চলাফেরা করতে পারছে না। আর বগুড়ার দই স্থানীয় লোকজনের চেয়ে বাইরের জেলার মানুষ বেশি খায়। ঢাকা বা অন্যান্য জায়গায় যখন বগুড়া থেকে কেউ যান, তখন কিন্তু তিনি দই নিয়ে যান। অন্য জেলার মানুষ এলে বগুড়া থেকে দই কেনেন। এভাবেই আমাদের ব্যবসা হয়। কিন্তু, বর্তমান অবস্থায় আমাদের ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, আমরা এর আগে একটা হিসাব করেছিলাম, বগুড়া জেলায় প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩ কোটি টাকার দই-মিষ্টি বিক্রি হয়। কিন্তু, কারফিউ’র সময়গুলোতে তারা উৎপাদন করতে পারেনি, বিক্রিও করতে পারেনি। আন্দোলন এবং কারফিউয়ে তো ব্যাপক ক্ষতি। কারণ, বগুড়ার টোটাল যে বিজনেস, সেটা তো আর এখন হচ্ছে না। ফ্যাক্টরিতে সীমিত আকারে প্রোডাকশন হলেও সেটি কোনো জায়গায় ঠিকমতো সেল করা যাচ্ছে না। এখন কিছু কিছু ফ্যাক্টরি সীমিত আকারে তাদের প্রোডাকশন চালাচ্ছে পরবর্তীতে সেল করার জন্য। কারফিউ’র প্রথম ৫ দিনে বগুড়ায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। দিনে ১০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে, বগুড়ায় সবচেয়ে বেশি দুধ উৎপাদন হয় শেরপুর উপজেলায়। এই দুধগুলোর ক্রেতাদের অধিকাংশই দই- মিষ্টি ও বেকারির মালিক। কারফিউয়ে দই-মিষ্টির কারখানা বন্ধ থাকায় গত কয়েকদিন দুধ বিক্রিতেও ধস নেমেছিল। ক্রেতা না থাকায় দুধ অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হয়েছে।
দুধ বিক্রেতা সোহেল, লুৎফর, আব্দুল লতিফসহ অনেকে জানিয়েছেন, তারা শেরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে দুধ সংগ্রহ করে উত্তর সাহাপাড়া এলাকার শিশুপার্ক দুধের বাজারে নিয়ে আসেন। সেখান থেকেই তারা দুধ বিক্রি করেন।
শেরপুর উপজেলার গজারিয়া এলাকার দুধ বিক্রেতা সোহেল জানান, তিনি দৈনিক পাঁচ মণ দুধ বাজারে বিক্রি করেন। কারফিউ চলাকালীন দই-মিষ্টির কারখানায় দুধের চাহিদা না থাকায় তিনি অর্ধেক দামে দুধ বিক্রি করেছেন। অনেক সময় বাজারে দুধ বিক্রি করতে না পারায় শহরের অলিগলিতেও ভ্যানে করে বিক্রি করা হয়েছে।
শালফা এলাকার দুধ বিক্রেতা লুৎফর, আমজাদ, ফারুক ও রাজ্জাক জানান, কারফিউ চলাকালে দুধ বিক্রেতারা বাজারে দুধ বিক্রি না করতে পেরে ভ্যানে করে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি করেছেন।
শেরপুর উপজেলার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেহানা খাতুন বলেন, এ উপজেলায় প্রতিদিন ১ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়। এই দুধগুলো স্থানীয় মানুষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দই, মিষ্টি, ঘি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরি এবং বেকারি কারখানায় ব্যবহার করা হয়। কারফিউ’র কারণে কয়েকদিন খামারিরা দুধের দাম ভালো পাননি বলে জেনেছি।
এনাম/রফিক