নারায়ণগঞ্জে ২২ মামলায় ৫৬২ জন গ্রেপ্তার
মো. দ্বীন ইসলাম অনিক, নারায়ণগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া নাশকতার মামলায় গত ৭ দিনে বিএনপি’র নেতাকর্মী, এইচএসসি পরীক্ষার্থী, গার্মেন্টস কর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীসহ ৫৬২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে ৮টি মামলা হয়েছে। এ নিয়ে জেলার ৭টি থানায় মামলার সংখ্যা ২২টি। এরমধ্যে নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ও ফায়ার সার্ভিসের দুই মামলা এবং ২০টি মামলা করেছে পুলিশ।
নাশকতার অভিযোগে পুলিশের মামলাগুলোতে নারায়ণগঞ্জ জেলা, মহানগর, থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
এ ছাড়াও মামলায় আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইসরাফিল প্রধান, নারায়ণগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি ও বন্দর উপজেলা পরিষদ নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের সহ-সভাপতি হোসেন মুন্সী, সিএনএন বাংলা টেলিভিশনের সাংবাদিক আলমগীর ভূইয়া, মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদ উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মাহমুদুল হাসান শুভ, মুছাপুর ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের ছেলে প্রান্ত, মদনপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জাবেদ ভূঁইয়ার ভাতিজা মোহাম্মদ ভূঁইয়া, মুছাপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি পদপ্রার্থী অপু, মদনপুর ইউপি’র মুসলিমপাড়া এলাকার মুদি দোকানদার ইউসুফ, তার ছেলে আনাফ ও মেয়ের জামাই জহিরুল হক, মুছাপুর ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির নেতা মাহবুব মেম্বার।
বন্দর উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ও জাতীয় পার্টির নেতা মাকসুদ হোসেন বলেন, ঘটনার দিন আমি বাসায় ছিলাম। পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় আমাকে ১০৭ নম্বর আসামি করা হয়েছে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন, তারাই এসব মিথ্যা মামলা করছেন।তার নির্বাচনী কর্মী-সমর্থকদের এ মামলায় আসামি করা হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদ উপনির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মাহমুদুল হাসান শুভ বলেন, উপনির্বাচনে জনগণের রায়কে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করতে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে আমাকে এবং আমার কর্মী-সমর্থকদের এ মামলায় আসামি করেছে। তিনি বলেন, আমি ১৮ জুলাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণায় ছিলাম।
সিএনএন বাংলা টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার সাংবাদিক আলমগীর হোসেন বলেন, আমরা পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। অথচ আমাকে এই মামলায় আসামি করা হলো। আমি এই মামলা থেকে মুক্তি চাই।
অন্যদিকে সিদ্ধিরগঞ্জ ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুল কাদির জিলানী হীরাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু তাকে না পেয়ে পুলিশ তার ভাই এইচএসসি পরীক্ষার্থী আবু রায়হান (১৮) কে গ্রেপ্তার করে। ২২ জুলাই মধ্যরাতে সিদ্ধিরগঞ্জের ৪নং ওয়ার্ডের আটিগ্রাম এলাকার নিজ বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আবু রায়হান ওই এলাকার মৃত মোখলেছুর রহমানের ছেলে। তিনি এবার তেজগাঁও সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন।
রায়হানের পরিবার জানায়, পরদিন সকালে আমরা পরীক্ষার প্রবেশপত্র নিয়ে থানায় গেলে আমাদের থানার ভেতর কোনোভাবেই প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। পরে আবু রায়হানের বিরুদ্ধে কোনো মামলা না দিয়ে ৫৪ ধারায় আদালতে পাঠিয়ে দেয়। ২৪ জুলাই আদালতে আবু রায়হানের জামিনের জন্য আবেদন করা হলে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণ করেন আদালত। আগামী ২৯ জুলাই রায়হানের পরবর্তী পরীক্ষা। এর আগে জামিন না দিলে ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। এদিকে ২৩ জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুল কাদির হীরাকে বন্দর থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
২১ জুলাই রাতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সহ-সভাপতি মোস্তফা কামালকে না পেয়ে তার ৩ ছেলে মাহফুজ, ফয়সাল ও সিয়ামকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। মিজমিজি পশ্চিমপাড়া হাইস্কুলের সন্নিকটের বাড়িতে এ সময় তারা রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। পরদিন তাদের নাশককতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায় পুলিশ। ২২ জুলাই ভোররাতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপি’র আরেক সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুনকে না পেয়ে তার প্রকৌশলী ছেলে আকাশ ও আরজুকে আটক করে। তাদের মধ্যে আকাশ বিজিএম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাস করে বের হয় এবং আরজু স্থপতি (আর্কিটেক্ট) বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যয়নরত। বাসার তালা ভেঙে ঘুমন্ত অবস্থায় তাদের পুলিশ আটক করে নিয়ে যায় বলে স্বজনরা অভিযোগ করেন। পরে তাদের নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
পুলিশের অভিযোগ, কোটা আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে আসামিরা চাষাঢ়া মোড়, ২নং রেলগেট, সদর থানা, ফতুল্লা থানার জালকুড়ি, ভূঁইগড়, সাইনবোর্ড, সিদ্ধিরগঞ্জ থানার শিমরাইল, চিটাগাং রোড, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোড়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ, সরকারি অফিস সার্ভিসের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ও পুলিশ পিবিআইএ অফিসেও তারা হামলা করে। এ ছাড়াও কাঁচপুর মেঘনা টোল প্লাজা, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মদনপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে। সেইসঙ্গে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড এসবি গার্মেন্ট, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, সাইনবোর্ড হাইওয়ে পুলিশ বক্স, বন্দর ধামগড় ফাঁড়ি, জালকুড়ি শীতল বাস ডিপো পুড়িয়ে দেয়। শিমরাইল ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোড়ে হাইওয়ে পুলিশ বক্সে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। একপর্যায়ে গত ২১ জুলাই পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, সেনাবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে নাশকতাকারীদের অপসারণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ২৫ জুলাই দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় ১৪টি নাশকতার মামলা করা হয় এবং রাতে চারটি থানায় নতুন করে আরও ৮টি মামলা করা হয়।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম-অপারেশন) চাইলাউ মারমা জানান, ১৪ মামলার পর নতুন করে আরও ৮টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ৩টি, ফতুল্লা থানায় ২টি, বন্দর থানায় ১টি ও সদর থানায় ২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
/টিপু/