ঢাকা     রোববার   ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ||  পৌষ ২৮ ১৪৩১

কোটা সংস্কার আন্দোলন

‘আমার কুলে পুলাডা ছটফটাইয়া মইরা গেলো’

তারিকুল ইসলাম, শেরপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩৩, ২৮ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ১৯:০৫, ২৮ জুলাই ২০২৪
‘আমার কুলে পুলাডা ছটফটাইয়া মইরা গেলো’

আসিফ

‘আমার কুলে (কোলো) পুলাডা (ছেলে) ছটফটাইয়া মইরা গেলো। মাথায় গুলি কইরা আমার বাপজানরে ওরা মাইরা ফেলাইছে। বাঁচবার লাইগা আমার বাপজান আমার কাছে কতোই না আকুতি করছে। আমি তো বাঁচাইতে পারলাম না। আমার পোলা তো কোনো রাজনীতি করতো না। তারপরেও আমার নিরাপরাধ পুলাডারে এভাবে মাইরা ফেলাইলো। আল্লাহ বিচার করবো।’ 

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া গার্মেন্টস কর্মী আসিফের বাবা আমজাদ হোসেন রোববার (২৮ জুলাই) কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন। নিহত আসিফ শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের কেরেঙ্গাপাড়া গ্রামের ব্যাবসায়ী আমজাদ হোসেনের ছেলে। 

জানা গেছে, গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন আসিফ। রাত ৯টার দিকে তার মৃত্যু হয়। গত ২০ জুলাই সকালে তার মরদেহ শেরপুরে আনা হয়। একই দিন দুপুরে সামাজিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

আরো পড়ুন:

রোববার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আমজাদ হোসেন তার ছেলে আসিফের কবরের পাশে বসে কাঁদছেন। বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, মা ফজিলা খাতুন বসে আছেন। তার দুই চোখ দিয়ে পানি ঝরলেও মুখের কথা আটকে ছিল। এক সময় জোরে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন তিনি। বাড়ির সবাই মাথায় পানি দিয়ে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করেন। ১০ মিনিটের মধ্যেই জ্ঞান ফেরে তার।

ফজিলা খাতুন বলেন, ‘আমার পোলাতো বড় চাকরি চাইনি। আমার পোলাতো রাজনীতিও করেনি। পেটের দায়ে গার্মেন্টসে চাকরি করতো। তাও আমার পুলাডারে এভাবে গুলি করে মারতে হইলো কেন? আমার কলিজার এভাবে মাথা ফুটা করে মারতে হইলো কেন? যারা আমার বাপেরে মারছে আল্লাহ তাদের বিচার কইরো।’

এলাকাবাসী জানান, আসিফের বাবা ২০ বছর ধরে ঢাকার মিরপুর এলাকায় ঝুটের ব্যবসা করেন। ব্যবসার কারণে অধিকাংশ সময় তিনি ঢাকাতেই থাকতেন। ছয় সন্তানসহ মোট ৮ জনের বড় সংসার তার। আসিফ ছিলেন ভাই-বোনদের মধ্যে দ্বিতীয়। আসিফের বড় বোনের বিয়ে হয়েছে ঢাকাতেই। অন্য সন্তানদের নিয়ে আসিফের মা গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। আসিফ বছর খানেক হলো মিরপুরের একটি গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেন। বাবার সঙ্গে মিরপুরেই থাকতেন তিনি। অল্প বেতনের চাকরি ছেড়ে আগামী মাস থেকে বাবার ঝুটের ব্যবসায় সাহায্যের কথা ছিল তার। প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন আসিফ। কিন্তু তা আর হলো না। এই নিষ্ঠুর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আসিফের বাবা নিজেই।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আসিফের বাবা আমজাদ হোসেন বলেন, ‘১৯ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজ পইড়া বাসায় আসি। এরপর বাপ-পোলা মিলা দুপুরের খাবার খাইয়া ঘুমাইতে যাই। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে পোলাডা কইলো এক বন্ধু ফোন দিছে, তার সঙ্গে দেখা করতে হবে। শুক্রবার বন্ধের দিন, তাই পুলারে মানা করিনি। কেরা (কে) জানে আমার পুলা আর ফিইরা আইবো না।’ 

তিনি আরও বলেন, “সন্ধ্যা ৬টায় দিকে পোলায় ফোন দিয়া কইলো ‘আব্বু আমি এক্সিডেন্ট করছি, তুমি তাড়াতাড়ি আসো’। আমি দৌঁড়াইয়া গিয়া দেখি মাথার ডান পাশে গুলি খাইয়া পুলাডা মিরপুরের আলোক হাসপাতালে পইরা আছে। তহন রাস্তায় এডা (একটা) রিকশাও নেই। যে কয়ডা আছে, ভয়ে যাইবার চায় না। পরে বুঝাইয়া একটা রিকশা নিয়া সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাই পুলাডারে। সেখানের ডাক্তারা মাথায় ব্যান্ডেজ কইরা রেফার (রেফার্ড) কইরা দেয় নিউরোসাইন্স হাসপাতালে। রিকশায় কইরা যখন নিউরোসাইন্স এ যাইতাছি তখন বাপে ব্যাথায় কাতরাইয়া কইতাছিলো ‘আমার উপর থেকে দাবি ছাইড়া দিও আব্বা। আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করবার পাইলাম না। আমি আর বাঁচবো না।’ তখন আমার বুকটা ফাইটা যাইতাছিলো। নিউরোসায়েন্সের ডাক্তাররা কইলো আমার বুকের ধন আর নাই। মইরা গেছে।”

এ বিষয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাসুদ রানা বলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ওই পরিবারের খোঁজ নেওয়া হবে। পরিবারটিকে সহযোগিতায় আমরা পাশে থাকবো।’

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

ঘটনাপ্রবাহ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়