বরগুনায় ২৫৪ ঝুঁকিপূর্ণ সেতু, পারাপারে আতঙ্ক
ইমরান হোসেন, বরগুনা || রাইজিংবিডি.কম
বাঁশ দিয়ে ভেঙে যাওয়া সেতুতে চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে মেরামত ও সংস্কার না করায় বরগুনা জেলায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) নির্মিত লোহার ২৫৪টি সেতু চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া দুটি উপজেলায় ১৮টি সেতু ভেঙে পড়ে আছে খালে। বিকল্প পথ না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ঝুঁকিপূর্ণ এসব সেতু পার হচ্ছে যানবাহন ও স্থানীয় অধিবাসীরা। এ কারণে এসব এলাকার লাখ লাখ বাসিন্দারা ভোগান্তিতে রয়েছেন। সম্প্রতি আমতলীতে সেতু ভেঙে ৯ জন নিহতের ঘটনায় কিছুটা হলেও টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নির্মাণের পর থেকে রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়ায় সেতুগুলো জরাজীর্ণ হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় ঝড়-বন্যায় অধিকাংশ সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) বরগুনা কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে এলজিইডির আওতায় ‘হালকা যান চলাচল (কম খরচে) প্রকল্পের অধীনে এসব সেতু নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে বরগুনা সদর উপজেলায় ৭০টি, বেতাগীতে ১৬টি, বামনায় ২৫টি, তালতলীতে ২৯টি, আমতলীতে ৯৮টি এবং পাথরঘাটায় ১৬টি লোহার সেতু পারাপারের অনুপযোগী হয়ে রয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, আমতলী সদর ও চাওড়া ইউনিয়নের মধ্যদিয়ে চাওড়া খালে দুই ইউনিয়নের সংযোগ স্থাপনে মহিষডাঙ্গা গ্রামে ২০০৬ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এক কোটি টাকা ব্যয়ে আয়রন সেতু নির্মাণ করেন। নির্মাণের তিন বছরের মাথায় ২০০৯ সালে ওই সেতুর মাঝখান দেবে যায়। ২০২১ সালের জুন মাসে ব্রিজের মাঝখান ভেঙে পড়ে। পরে বিকল্প রাস্তা না থাকায় ভাঙা সেতু নিজ উদ্যোগে যেনতেনভাবে মেরামত করে চলাচল করছেন স্থানীয়রা।
এছাড়াও উত্তর টেপুরা সেতুর লোহার বীম ভেঙে গেছে সাত বছর আগে। স্থানীয়রা সেতুর পাশে কাঠের সেতু নির্মাণ করে চলাফেরা করছে। একই ইউনিয়নের তক্তাবুনিয়া খালে তক্তাবুনিয়া সেতু গত তিন বছর আগে মাঝখান দিয়ে ভেঙে গেছে। ওই সেতু দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তালতলী উপজেলার শারিকখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ বাদুরগাছা গ্রামে বাদুরগাছা খালের উপর নিমিত লোহার অবকাঠামোতে নির্মাণ করা সেতুটি প্রায় ১০ বছর ধরে মাঝখান দিয়ে ভেঙে পড়ে আছে। পরে পারাপারের জন্য সেতুর পাশেই খালে বাঁধ দেওয়া হয়েছে।
বরগুনা সদর উপজেলার বরগুনা সদর ইউনিয়নের পাজরাভাঙ্গা এলাকায় খালের সেতুটির দুই পাশের হাতল ভেঙে গেছে। গৌরিচন্না ইউনিয়নরে বিবেক চত্বর ও খাজুর তলা এলাকার লোহার ব্রিজ দুইটি দেবে ও হাতলা ভেঙে গিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
বরগুনা সদর উপজেলা খাজুরতলা গ্রামের বাসিন্দা নিজাম হাওলাদার বলেন, আমাদের এই সেতুটি পাঁচ বছর ধরে বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে। এই সেতু মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই।
আমতলীর মহিষডাঙ্গা গ্রামের সুমন মল্লিক বলেন, এই সেতু ভেঙে যাওয়ায় ৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ ১০ গ্রামের অন্তত ২০ হাজার মানুষ ভোগান্তিতে রয়েছেন।
মাছুয়াখালী এলাকার রুবেল গাজী বলেন, নির্মাণের পাঁচ বছরের মাথায় সেতুর বীম ভেঙে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ সেতু দিয়ে ভারী যানবাহন চলতে পারে না। আমরা ভয়ে ভয়ে সেতু পাড় হচ্ছি। যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে।
নলুয়াবাগী গ্রামের খলিলুর রহমান বেপারী বলেন, ‘মোগো দুঃখ কেউ দ্যাখবে না। গত পাঁচ বচ্ছর ধইর্যা মোরা কষ্ট হরি কেউ মোগো দিকে চায় না। মোরা একটা গার্ডার সেতু চাই।’
তালতলীর শারিকখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ বাদুরগাছা গ্রামের বাসিন্দা নাসির হোসেন বলেন, আমাদের এলাকা থেকে তালতলী শহরের সাথে সহজ যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এই সেতুটি দশ বছর ধরে পরিত্যক্ত। পারাপারের জন্য খালে বাঁধ দেওয়া হয়েছে।
শারিকখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক হোসেন বলেন, আমার ইউনিয়নের ১১টি সেতু ঝুঁকিপূর্ণ। এসব সেতু দিয়ে প্রতিদিন শিক্ষার্থীসহ এলাকার সব বাসিন্দারা চলাচল করেন। আমি বার বার মেরামত ও সংস্কারের জন্য এলজিইডি অফিসে গিয়েছি। কিন্তু তারা কিছুই করেনি।
এ বিষয়ে এলজিইডির আমতলী উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আলম মামুন বলেন, আমতলীতে ৯৮টি আয়রন সেতু চলাচলের অনুপযোগী, তার একটি তালিকা করে আমরা জেলা অফিসে পাঠিয়েছি। এসব ব্রিজগুলো প্রতিস্থাপনের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
স্থানীয় সরকার অধিদপ্তর এলজিইডি বরগুনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মেহেদি হাসান খান বলেন, বরাদ্দ না থাকায় আমরা মেরামত অথবা সংস্কার করতে পারিনি। তবে, ব্যবহারের অনুপযোগী ও ধসে পরা সেতুর তালিকা তৈরি করে প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনা পেলেই আমরা এ বিষয়ে কাজ শুরু করবো।
বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম সরোয়ার টুকু রাইজিংবিডিকে বলেন, মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছি। এর আগে যে সংসদ সদস্য ছিলেন, তিনি শুরু থেকেই যদি ঊর্ধ্বতনদের সাথে ধাপে ধাপে সেতুগুলোর মেরামত ও সংস্কারের জন্য কথা বলতেন তাহলে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর এতো বড় একটা সংখ্যা হতো না। আমি ৬ মাস আগে দায়িত্ব নিয়েছি। একটু সময় লাগবে। তবে, উন্নয়ন কাজ সব সেতুতেই হবে।
/ইমন/