কোটা আন্দোলন
গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থীদের পানি দিতে গিয়েই লাশ হন আলমগীর
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
আলমগীর শেখের মা আলেয়া খাতুন ও মেয়ে, (ইনসেটে আলমগীর)।
আলমগীর শেখ। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
স্বজনদের ভাষ্য, ১৯ জুলাই জুমার নামাজ শেষে স্ত্রীকে রান্নার কথা বলে রামপুরা এলাকায় বের হন আলমগীর। সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে কিছু আন্দোলনকারী সড়কে লুটিয়ে পড়েন। তখন তিনি পানির বোতল নিয়ে আহতদের পানি দিতে যান। সে সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে আলমগীর আহত হন। ওইদিন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আলমগীরকে তার সহকর্মীরা হাসপাতালে নিলেও সেখানে কোনো চিকিৎসক ছিলো না। চিকিৎসা না পেয়ে সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। শরীর থেকে গুলিও বের করা হয়নি। ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার লাশ ২১ জুলাই গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। কান্না থামছে না আলমগীরের বাবা-মা ও স্ত্রী সন্তানের।
২০ বছর আগে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসেন কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের কসবা গ্রামের আলমগীর শেখ। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। বাবা ইজারুল হক, মা আলেয়া খাতুন, স্ত্রী রিমা খাতুন, মেয়ে তুলি খাতুন (১১), ছেলে আব্দুল আওলাদ (৭) ও ছোট ভাই আজাদ হককে নিয়ে তার সংসার। অন্য ভাইয়েরা আলাদা থাকেন।
আট বছর ধরে রামপুরা এলাকায় হেলথ কেয়ার ফার্মাসিটিক্যালের গাড়িচালক হিসেবে কাজ করেন আলমগীর শেখ। স্বল্প আয়ে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া তার জন্য কষ্টকর ছিলো। সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে গাড়ি চালানোর পাশাপাশি পাঠাও অ্যাপসের মোটরসাইকেল চালাতেন তিনি।
শুক্রবার (১৯ জুলাই) মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন। ঢাকার রামপুরা বিটিভি ভবনের সামনে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ চলার সময় গোলাগুলির মধ্যে পড়ে যান। সে সময় আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে ছোড়া গুলিতে কয়েকজন শিক্ষার্থী লুটিয়ে পড়েন। পানির বোতল নিয়ে তাদের পানি পান করাতে যান আলমগীর। সে সময় গুলিতে গুরুতর আহত হন তিনি। তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক না থাকায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সেখানে মারা যান তিনি। ময়নাতদন্ত ছাড়াই শনিবার (২০ জুলাই) গভীর রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে কোম্পানির লোকজন গ্রামের বাড়িতে তার লাশ নিয়ে আসে।
পরদিন রোববার (২১ জুলাই) সকালে গ্রামের কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। ঘটনার পর থেকেই কসবা গ্রামে আলমগীরের বাড়িতে দেখা যায় স্বজন ও এলাকাবাসীর ভিড়। অঝোরে কাঁদছেন মা আলেয়া খাতুন। পাশেই বাকরুদ্ধ বাবা। স্বজনরা তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
আলমগীরের বাবা ইজারুল হক বলেন, ‘আমার ছোট দোকান। বেটার টাকায় ছোট ছোয়ালের পড়াশোনাসহ ছয়জনের সংসার চলতো। তারও দুটি সন্তান রয়েছে। এহন কিডা তাদের দেখবে।’
আলমগীর শেখের ছোট ভাই আজাদ শেখ বলেন, ওইদিন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভাইকে তার সহকর্মীরা হাসপাতালে নিলেও সেখানে কোনো চিকিৎসক ছিলো না। চিকিৎসা না পেয়ে সেখানেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। শরীর থেকে গুলিও বের করা হয়নি। ময়নাতদন্ত ছাড়াই আমার ভাইয়ের লাশ দাফন করা হয়।
আলমগীরের স্ত্রী রিমা খাতুন বলেন, চাকরির টাকায় সংসার চলতো না। অবসরে পাঠাও মোটরসাইকেল চালাতেন। এখন তো সব শেষ। শ্বশুর, শাশুড়ি, ছেলে, মেয়ে নিয়ে কি খাবো।
আলমগীরের মা আলেয়া খাতুন বলেন, ‘আমার বেটা রাস্তায় গুলিবিদ্ধ ছেলেদের পানি খাওয়াতে গিয়েছিলো। তাকে গুলি করে মেরে ফেললো। হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসা পেলো না। বেটা আর ফিরে আসলো না। গুলিসহ তারে দাফন দেওয়া হলো। আমি কার কাছে বিচার চাইবো।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম মিকাইল ইসলাম বলেন, কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে নিহতদের খোঁজখবর নেওয়াসহ তালিকা করা হচ্ছে। সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কাঞ্চন/ইমন