ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মেয়ের জন্য চিপস কিনতে গিয়ে প্রাণ হারান বাবা

রুমন চক্রবর্তী, কিশোরগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫২, ৪ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ১৭:৪৬, ৪ আগস্ট ২০২৪
মেয়ের জন্য চিপস কিনতে গিয়ে প্রাণ হারান বাবা

সেদিন ছিলো ১৯ জুলাই শুক্রবার। ঢাকার রায়েরবাগে জুমার নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বাসায় ফেরেন মোবারক হোসেন। তখন আড়াই বছরের মেয়ে বায়না ধরে চিপস খাবে। মেয়ের বায়না রাখতে বাসার নিচের দোকানে যান। কিন্তু চিপস কিনে আর বাসায় ফেরা হয়নি তার। 

মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মোবারকের নিথর দেহ পরেছিলো রাস্তায়। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি ক্লিনিক তারপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু বাঁচানো যায়নি মোবারককে। ঘটনার দুই দিন পর গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয় তাকে। 

পরিবার সূত্রে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ পৌরসভার পূর্ব নয়াকান্দি এলাকায় আবুল হাশেমের ছেলে মোবারক (৩০)। তিনি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকার রায়েরবাগের আপন বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। সঙ্গে ছোট ভাই মোশারফ হোসেন, ভাইয়ের স্ত্রী ও মা বসবাস করতেন। 

মোবারক তখন ছোট। সে সময় বাবা তাদের মাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তারপর মা ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজ করে দুই সন্তানকে বড় করেন। দুই ভাই নবাবপুর এলাকার একটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। মাসে বেতন হিসেবে যা পেতেন তা দিয়ে সংসারটা কোনো রকমে চলে যাচ্ছিলো। 

কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে একটি গুলির আঘাতে পরিবারটির সব কিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। 

আড়াই বছরের ছোট্ট মেয়ে আদিবা বাবাকে ময়না বলে ডাকতো। এখনো সেই নাম ধরেই ডেকে চলেছে। বাবা আর বেঁচে নেই এটা বুঝে উঠারও  সামর্থ্য হয়নি তার। 

নিহত মোবারকের ছোট ভাইয়ের বউ পপি আক্তার বলেন, ঘটনার দিন (১৯ জুলাই) শুক্রবার ছিলো। বড় ভাই (মোবারক) বাসার পাশের মসজিদ থেকে জুমার নামাজ আদায় করে ঘরে ফিরে। তখন আদিবা চিপস খাওয়ার বায়না ধরে। কিন্তু এসময় বাসার নিচে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিলো। সে বিষয়টি বড় ভাই বুঝতে না পেরে বাসার নিচের দোকানে চিপস আনতে যায়। অনেকক্ষণ সময় চলে গেলে বড় ভাই (মোবারক) আসছে না দেখে, ছোট ভাই ঊনাকে খুঁজতে বাসার নিচে যান। গিয়ে দেখেন বড় ভাই মাটিতে পড়ে আছেন। একটি গুলি তার মাথার এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। পরে ঊনাকে প্রথমে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাই। সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসক বড় ভাইকে মৃত ঘোষণা করেন।

মোবারকের মা মোছা. জামেনা ছেলের প্রসঙ্গ আসতেই বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। কোনোভাবেই ছেলের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, খুব ছুডু থাইক্যা পুলার বাপ আমরারে ছাইড়া গেছে গা। এরপর থেইক্যা মাইনষের বাড়িত বাড়িত কাম কইরা পুলা দুইডারে বড় করছি। পুলা দুইডারে বিয়া করাইছি। কি সুন্দর আছিলো আমরার সংসারটা। অহন আমরার কি অইবো, এই শিশু বাচ্চাডার ভবিষ্যত কি অইবো, কেরা আমরারে দেখবো। 

মোবারকের বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে এলোমেলো হাঁড়িপাতিল, রান্নার চুলাসহ সংসারের জিনিসপত্র ও আসবাব স্তূপ করে রাখা। মোবারক নিহত হওয়ার পর ছোট ভাই মোশারফ সবাইকে নিয়ে বাড়িতে চলে এসেছেন। 

স্বামী মোবারককে হারিয়ে শোকে পাথর স্ত্রী শান্তা আক্তার। আট বছর হয়েছিলো তাদের বিয়ের বয়স। এরই মাঝে দুটি মৃত্যু দেখেছেন তিনি। প্রায় তিন বছর আগে ক্যান্সারে মারা যায় তার প্রথম সন্তান। সে অবস্থা থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো সংসারে মনোযোগ দেন। কিন্তু এবারের মৃত্যু যে তাকে সর্বহারা করে দিয়েছে। কিছু জানতে গেলেই মেয়েকে কোলে টেনে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। 

তিনি বলেন, কী অপরাধ ছিলো আমার স্বামীর? কেন তাকে এভাবে গুলিতে মরতে হলো? মেয়েটা বাবাকে ময়না বলে ডাকতো। সারাটা দিন বাবাকে ডেকে খুঁজে বেড়ায়। সে তো জানেই না তার বাবা এই পৃথিবীতে আর নেই। এখন এই ছোট্ট শিশুকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবো? কী করবো? কিছুই বুঝতেছি না।

মোবারকের চাচা রেশম মিয়া বলেন, ওর মা ছোট থেকে কোলে পিঠে করে, মানুষের বাড়িতে কাজ করে ওদের বড় করেছেন। ছেলে দুটোও খুব বিনয়ী ও পরিশ্রমী। এলাকায় সবাই খুব পছন্দ করে তাদের। কিন্তু সংঘর্ষে গুলির আঘাতে ওর মৃত্যুটি যেন নিরবই রয়ে গেলো। আমরা সাধারণ গরীব মানুষ। এত আন্দোলন দেখে মোবারক গুলিতে নিহত হওয়ার পরও কোনো আন্দোলন করতে পারিনি। তাই নিরবে ওর মরদেহ নিয়ে এসে দাফন করেছি। এখন সরকারের কাছে একটাই প্রত্যাশা, যার মৃত্যু হয়েছে সেতো আর ফিরে আসবে না। কিন্তু তার শিশু বাচ্চাটার ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে সরকার যেন তাদের পাশে দাঁড়ায়।  

এ ব্যাপারে কথা হয় করিমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা আলীর সাথে। তিনি বলেন, এমন মৃত্যু একটি পরিবারের জন্য খুবই কষ্টদায়ক ও দুঃখজনক। আমি নিহত মোবারক হোসেনের পরিবারের সাথে কথা বলে তার পরিবার যেন সরকারি সহায়তা পায় এ বিষয়ে দ্রুতই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাবো।

/টিপু/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়