ঢাকা     সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ৯ ১৪৩১

রাজশাহীতে সরকার পতনের পর থেকে আগুন-ভাঙচুর-লুটপাট

রাজশাহী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৪, ৬ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ১৭:২৮, ৬ আগস্ট ২০২৪
রাজশাহীতে সরকার পতনের পর থেকে আগুন-ভাঙচুর-লুটপাট

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ পর থেকেই রাজশাহীতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘরবাড়ি ও দলীয় কার্যালয় থেকে সব জিনিসপত্র লুট করার পর দরজা-জানালা এমনকি ইটও খুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সোমবার (৫ আগস্ট) বিকাল থেকে শহরে অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সকালেও লুটপাট চলছিল।

রাজশাহীর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় আগের দিন দেওয়া আগুন মঙ্গলবার সকালেও জ্বলতে দেখা গেছে। পুরো শহরের কোথাও পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি। লুটপাট হয়ে গেছে রাজশাহী নগর পুলিশের (আরএমপি) সদর দপ্তর ও বিভিন্ন থানা। এসব স্থান থেকে যার যা ইচ্ছে নিয়ে যাচ্ছেন। 

সোমবার বিকালে নগরীর উপশহরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের চারতলা বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। তার আগে বাড়ির সব আসবাবপত্র লুটপাট করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে বাড়িটির সামনে গিয়ে দেখা যায়, এখনও অসংখ্য মানুষ বাড়ির দরজা, জানালা, গ্রিল ও পানির লাইনের পাইপ খুলে নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে কয়েকজনকে হাতুড়ি দিয়ে দেয়াল ভেঙে পাইপের গেট খুলতে দেখা যায়।

আরো পড়ুন:

সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে গিয়ে দেখা যায়, দশতলা ভবনের নিচতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন শাখা অফিসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ফাইলপত্র। ফাইল কেবিনেট, আলমিরাগুলো ভাঙা। তালা ভাঙতে না পারলে দরজা ভেঙে কক্ষগুলোর ভেতরে ঢুকেছে দুর্বৃত্তরা। নগর ভবনের দোতলায় মেয়রের দপ্তরসহ অন্যান্য কক্ষগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মঙ্গলবার সকালেও আগুনের ধোয়া উঠছিল এই ছাই থেকে। প্রতিটি কক্ষের এসি, ফ্যান, কম্পিউটারসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ষষ্ঠ তলায় শুধু মসজিদের এসিগুলো আছে। সেখানকার পর্দাগুলো খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

নগরীর রানীবাজারে সাততলা একটি ভবনের চারতলায় মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের ব্যক্তিগত কার্যালয় ছিল। সকালে এ ভবনের এসির কম্প্রেসারগুলোও খুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়। নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত পোশাকের শোরুমগুলো লুট হয়েছে আগের দিন বিকালেই। সকালে ট্রাক ভিড়িয়ে এসব শোরুমের লোহার মালামালগুলো খুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়।

আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি ও দলের কার্যালয় ভেঙে ইট লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়

নগরীর বোয়ালিয়া থানায় গিয়ে দেখা গেল, কয়েকটি গাড়ি ও অন্তত ৩০টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। থানার পেছনে ওসির বাসভবন থেকে তখনও ধোয়া বের হচ্ছে। থানায় কোনো পুলিশ নেই। যে যার ইচ্ছামতো মালামাল লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। থানার পেছন দিকে জড়ো করে রাখা বিভিন্ন মামলার জব্দ করা মোটরসাইকেল যার যেটা পছন্দ হচ্ছে, সেটা নিয়ে যাচ্ছে। একজনকে থানার একটি কক্ষ থেকে জব্দ করা কয়েকটি ধারালো অস্ত্র নিয়ে বের হতে দেখা যায়। অন্তত ২০ জন যুবককে থানার পেছন থেকে দামি দামি মোটরসাইকেল বের করে নিয়ে যেতে দেখা যায়।

নগরীর সিঅ্যান্ডবি মোড়ে আরএমপির সদর দপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো পুলিশ নেই। বহুতল এ ভবনটিও আগুনে পুড়েছে। ভবনের সামনে পাঁচটি গাড়ি ও কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। দোতলায় পুলিশ কমিশনারের কক্ষে টেবিল ছাড়া আর কিছুই নেই। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি, আইনের বইপত্র। প্রশাসনিক কর্মকর্তার কক্ষ থেকে এক যুবককে বিভিন্ন নথিপত্রের ফাইল গুছিয়ে নিয়ে যেতে দেখা গেল।

আরএমপি সদর দপ্তরের সামনে পশ্চিমপাশে একতলা টিনশেড ভবনে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও সাইবার ক্রাইম ইউনিট ছিল। রাজশাহী-রংপুর বিভাগের ডিজিটাল মাধ্যমের অপরাধের তদন্ত করা হতো এখান থেকে। এছাড়া পুরো শহরে লাগানো পুলিশের সিসি ক্যামেরাগুলোতে চোখ রাখা হতো প্রায় অর্ধশত বড় বড় মনিটরের মাধ্যমে। কোথাও কোনো অপরাধ হলে সহজেই অপরাধীকে শনাক্ত করা যেত। সকালে মনিটরগুলোর একটিও দেখা যায়নি। সাইবার ক্রাইম ইউনিট পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অফিসের এক কোণে অন্তত হাজারখানেক অভিযোগ ও এর তদন্ত প্রতিবেদন ফাইল করে বাধা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। 

নগরীর রায়পাড়া এলাকায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার গরুর খামার ছিল। সকালে গুরুগুলো দেখা যায়নি। এ খামারে খড়ের পালায় আগুন জ্বলছিল। খামারের ইটগুলো খুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কাশিয়াডাঙ্গা পুলিশ বক্স ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখা যায়। ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নথিপত্র। পাশেই ফায়ার স্টেশন থাকলেও কাশিয়াডাঙ্গা থানার সামনে তিনটি গাড়িতে আগুন জ্বলছিল মঙ্গলবার সকালেও। কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজব আলীর নির্মাণাধীন দোতলা কমিউনিটি সেন্টারের দরজা-জানালা খুলে নেওয়া হয়েছে। সকাল থেকে লোকজনকে কমিউনিটি সেন্টারটির ইট খুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়। 

নগরীর কোর্ট স্টেশনে যুবলীগ নেতা নাহিদ আক্তার নাহান ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা আজিজুল আলম বেন্টুর ব্যক্তিগত কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। কল্পনা সিনেমা হলের মোড়ে বেন্টুর একটি রেস্তোরাঁ আছে। এখানকার সব মালামাল লুট হয়েছে। মঙ্গলবার সকালেও দরজা-জানালা খুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়। লিলিহলের মোড়ে বেন্টুর একটি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে। ইট খুলতে খুলতে এটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কমিউনিটি সেন্টারের সামনে বেন্টুর ৯টি ড্রাম ট্রাক ছিল। ট্রাকগুলোর সামনের অংশ সোমবার বিকালে আগুনে পুড়ে গেছে। মঙ্গলবার ট্রাকগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে যেতে দেখা যায় শতাধিক মানুষকে।

আওয়ামী লীগ নেতা বাড়ি  ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা হয়

নগরীর সিটিহাটে জেলা আওয়ামী লীগের একটি কার্যালয় ছিল। সোমবার বিকালে এখানেও অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে কার্যালয়ের সামনের ফাঁকা স্থানে বিছিয়ে রাখা ইটগুলোও ১৫-২০ জন যুবককে ভ্যানে করে তুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়। নগরীর মহিষবাথান এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের জব্দ করা যানবাহনের গ্যারেজ আছে। এখান থেকে দুদিন ধরে রিকশা, অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল লুট করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। নগরীর কুমারপাড়ায় মহানগর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় সোমবার বিকালে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সকাল থেকে এখানকার সব ইট ভ্যানে তুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়।

সোমবার রাজশাহীর নগর ভবনের নিচতলায় আগ্রণী ব্যাংকের একটি শাখায় ভাঙচুর করা হয়। তবে ব্যাংকটির ভল্ট ভাঙতে পারেনি হামলাকারীরা। তবে নগর ভবনের পশ্চিমপাশে মিডল্যান্ড ব্যাংকের এটিএম বুথ লুট করা হয়। রাজশাহীর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় রিসোর্টে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। মঙ্গলবার সকালে ওই এলাকায় পর্যটন মোটেলের বার থেকে চেয়ার- টেবিল ও এসিসহ বিভিন্ন মালামাল নিয়ে যেতে দেখা যায়।

সোমবার রাজশাহীর চৌদ্দপাই এলাকায় বেসরকারী নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতেও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আব্দুল খালেক। এছাড়া শহরের পাড়া-মহল্লায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সবগুলো দলীয় কার্যালয় জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গোটা জেলাজুড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা ও লুটপাট হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রাজপাড়া থানা এবং মালোপাড়া ও কাটাখালী পুলিশ ফাঁড়ি।

মঙ্গলবার নতুন করে জেলার পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়ন পরিষদে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাদত হোসেন সাগর ও তার বাবা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি এমদাদুল হক এমদাদ কোনোরকমে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন। রাতে গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মোহাব্বত আলী মিন্টুর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাজশাহীর আরও বিভিন্ন এলাকা থেকে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে।

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে রাজশাহীতে পুলিশের কোনো কার্যক্রম নেই। তারা কী করবেন সেটা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে জেলাজুড়ে যে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চলছে তা বন্ধের জন্য আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়েছি। আজ আমি বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বসেছি। তারা নিজেদের মতো করে মাঠের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করবেন। আমরা মাইকিং করব। এছাড়া পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী আজ প্রতিটি উপজেলায় মিটিং করেছে। আশা করছি পরিস্থিতি দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
 

কেয়া/বকুল 

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়