নানা সমস্যায় জর্জরিত গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতাল
মাসুম লুমেন, গাইবান্ধা || রাইজিংবিডি.কম
গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতাল
হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ সচল যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অভাবে পড়ে আছে। বাধ্য হয়ে অধিকাংশ রোগী বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করছেন বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা। নোংরা আর দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশের পাশাপাশি গড়ে উঠেছে দালালদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এছাড়াও, শয্যা ও চিকিৎসক সংকটসহ নানা সমস্যা রয়েছে গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।
রোগীদের অভিযোগ, হাসপাতালের বারান্দা ও মেঝের চারপাশে এতো ময়লা আর দুর্গন্ধ যে টিকে থাকা মুশকিল। টয়লেটগুলোতে নাকে রুমাল না ধরে প্রবেশ করা যায় না।
রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, হাসপাতালের পুরুষ, নারী, শিশু, ডায়রিয়া এবং গাইনিসহ সবগুলো ওয়ার্ডেই বেডের সংকট প্রকট। সেই সঙ্গে পরিবেশও নোংরা। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভেতরে ও বারান্দার মেঝেতে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতাল চত্বর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়েও উদাসীন কর্তৃপক্ষ। রোগী ও স্বজনের অতি প্রয়োজনীয় বাথরুমের অবস্থাও বেহাল।
বেড না পেয়ে বাধ্য হয়ে হাসপাতালের মেঝেতেই থাকছেন রোগীরা
তারা জানান, হাসপাতালে নারীদের ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত টয়লেট ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় তা তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। পুরুষদের ব্যবহারের জন্য যে টয়েলেট রয়েছে, সেটিও ব্যবহার উপযোগী নয়। ঠিক কতো বছর আগে টয়লেট পরিষ্কার বা সংস্কার করা হয়েছে, তা হাসপাতালের কেউ জানাতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়েই হাসপাতালের নিচতলার পুরুষ ওয়ার্ডের একটি টয়লেটে রোগী ও স্বজনরা প্রাকৃতিক কাজ সারছেন। হাত-মুখ ধোয়ার একমাত্র বেসিনটিতেও মরিচা ধরেছে।
পলাশবাড়ী উপজেলার হরিনাবাড়ি থেকে এসে গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ফজল মিয়া নামে এক বৃদ্ধ। সঙ্গে ছিলেন তার নাতি রানা মিয়া। রানা বলেন, ‘পর্যাপ্ত ফ্যান না থাকায় হাতপাখা দিয়েই রোগীকে বাতাস করতে হচ্ছে। বেড না পাওয়ায় মেঝেতে রোগী রাখতে বাধ্য হয়েছি। বারান্দা ও মেঝের চারপাশে এতো ময়লা আর দুর্গন্ধ যে টিকে থাকা মুশকিল। বারবার বমি আসছে।’
হাসপাতালের বারান্দার পাশে ময়লার স্তূপ
তিনি আরও বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) সকালে রোগী ভর্তি করেছি। সেদিন দুপুর ১টা পর্যন্ত ডাক্তার রোগী দেখতে আসেনি। রোগীর অবস্থা ভালো ছিল না। গরমেও হাসপাতালে টিকে থাকা যাচ্ছিল না।’
গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রাম থেকে আসা বিপুল মিয়া পুরুষ ওয়ার্ডের বারান্দার মেঝেতে শুয়ে ছিলেন। তিনি চিবিৎসা নিতে এসেছেন এই হাসপাতালে। সঙ্গে ছিলেন তার ছোট ভাই মশিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘কে বা কারা আমার বড় ভাইকে চেতনানাশক কিছু খাইয়েছিল। গতকাল রাতে হাসপাতালে ভাইকে ভর্তি করেছি। বেড পাইনি। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা দিয়েছিল, সেগুলো সব করেছি। আজ সকালে ডাক্তার রাউন্ড দিতে এসে শুধু রোগীর নাম জিজ্ঞাসা করেছে। পরীক্ষার রিপোর্ট পর্যন্ত দেখেননি। ডাক্তার না থাকায় আমরা এখান থেকে রিলিজ (ছারপত্র) নিয়ে অন্য কোনো হাসপাতালে গিয়ে ভাইকে চিকিৎসা করাবো।’
জেলা শহর থেকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। উপজেলার পশ্চিম ছাপরহাটি গ্রাম থেকে এসে হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডের ৪৭ নম্বর বেডে থাকছেন মোসলেম মিয়া। তিনি বলেন, ‘তিনদিন হলো এখানে ভর্তি আছি। মাথায় চারটি সেলাই পড়েছে। সিটি স্ক্যান নাকি এখানে হয় না। বাইরে থেকে লোক এসে ৩৫০০ টাকা নিয়ে করে দিয়েছে।’
ব্যবহার অনুপযোগী হাসপাতালের টয়লেট
তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালের টয়লেটের অবস্থা খুবই খারাপ। একবার গেলে দ্বিতীয়বার যাওয়ার ইচ্ছা থাকে না।’
আধা ঘণ্টা ধরে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে কোলে শিশু নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সদর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের বাসিন্দা কছিম উদ্দিন। কানের ব্যাথায় ছটফট করা শিশু সন্তানকে কোনোভাবেই সামলাতে পারছিলেন না তিনি। তিনি বলেন, ‘আধা ঘণ্টার বেশি হবে, এখানে ডাক্তারের অপেক্ষা করছি। ছেলে কানের ব্যাথায় চিৎকার চেচামেচি করছে।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে বড় ধরনের কোনো অপারেশন হয় না। সামান্য জটিল রোগী হলেও তাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা অন্যত্র চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া, হাসপাতালে প্যারামেডিকসের কোর্স করা অসংখ্য শিক্ষার্থী ইন্টার্নশিপ করার নামে মেডিক্যাল অফিসারের রুমে ভিড় করে বসে থাকেন। এমনকি মেডিক্যাল অফিসারের চেয়ারে বসে রোগীদের চিকিৎসাপত্রও দেন তারা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রশাসনিক ও পরিসংখ্যান কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন খাতে কর্মচারীর পদ রয়েছে ১৯১টি। এর মধ্যে চিকিৎসকসহ ৫৫টি পদই শূন্য। হাসপাতালে ৪৩ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও চিকিৎসক রয়েছেন ২০ জন। ২৩ জন চিকিৎসকের পদ শুন্য রয়েছে। ফলে হাসপাতাল পরিচালনায় নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
হাত ধোয়ার বেসিনে মরিচা ধরেছে
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, দুই থেকে তিনজন সিনিয়র চিকিৎসকের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারণে এখানে অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহারে জনবল নেই। এ ক্ষেত্রেও ওই সিন্ডিকেটের ভূমিকা রয়েছে। নতুন কোনো ইসিজি মেশিন আনতে না আনতেই তা অকেজো করে দেওয়া হয়। বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ইসিজি মেশিন নিয়ে এসে পরীক্ষা করানো হয়। এক্সরে মেশিন দুটি চালু আছে। আলট্রাসনোগ্রাম করার মেশিন সচল থাকলেও অধিকাংশ পরীক্ষা করতে হয় হাসপাতালের বাইরে থেকে। হাসপাতালের রেডিওলজিস্ট পদটিও শূন্য।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের একজন সিনিয়র কর্মচারী জানান, একটি সিন্ডিকেট গোটা হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কারণে রোগীর খাবারের মানও নিম্ন পর্যায়ে। চারজন সুইপার দিয়ে গোটা হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করানো হয়। এ কারণে টয়লেটগুলোর অবস্থা বেহাল। নাকে রুমাল না ধরে সেখানে ঢোকা যায় না।
একই শর্তে হাসপাতালের একজন নার্স জানান, প্রতিদিন এই বিপুল সংখ্যক রোগী সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। ১০০ শয্যার রোগীর সেবা দিতে গিয়ে ২৫০-৩০০ রোগীর সেবা দিতে হয়। কাঙ্খিত সেবা না পওয়ায় রোগীরা আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত হন।
গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. মাহবুর হোসেন বলেন, ‘শূন্য পদে জনবল চেয়ে অসংখ্যবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠানো হয়েছে। গত জুলাই মাসে আবারও জনবল চেয়ে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। হাসপাতালের সব সংকট নিরসন করার পাশাপাশি রোগীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
মাসুদ