ঢাকা     শনিবার   ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  ভাদ্র ৩০ ১৪৩১

‘সন্তান হত্যার ভিডিও দেখা নরকসম কষ্টের’

আরিফুল ইসলাম সাব্বির, সাভার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৮, ২২ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ১৯:৪৯, ২২ আগস্ট ২০২৪
‘সন্তান হত্যার ভিডিও দেখা নরকসম কষ্টের’

শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন

‘সন্তানের মৃত্যু মানে আমৃত্যু কষ্ট, আর ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যার ভিডিও দেখা যেন নরকসম কষ্টের’, বলছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ঢাকার সাভারে নির্মমভাবে নিহত শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন।

গত ১৮ জুলাই সাভারে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ঢাকার মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এই শিক্ষার্থী। তার মৃত্যুর আগের শেষ মুহূর্তে পুলিশের করা নির্মম আচরণ দাগ কেটেছে দেশবাসীর মনে। সেই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশের নীল রংয়ের একটি সাঁজোয়া যানের ওপরে ন্যুজ অবস্থায় পড়ে আছে এক তরুণ। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়িটি মহাসড়কে থেমে যায়। একজন পুলিশ সদস্য গাড়িটি থেকে বেরিয়ে আসেন। ওই তরুণকে টেনে নিচে ফেলে দেন, যেন মানুষ নয়, জড় বস্তু কোনো!

নিচে ফেলে দেওয়ার পর ওই তরুণের দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এক পা ভাঁজ হয়ে পড়ে। আরেক পা আটকে যায় গাড়ির চাকায়। আরেক পুলিশ সদস্য গাড়ি থেকে নেমে তাকে হেঁচকা টানে ছাড়িয়ে নেন। এরপর তাকে টেনে মহাসড়কের পাশে নেন। তার নিঃশ্বাস তখনও চলছে, দেখা যায়। কিন্তু অমানবিকভাবে জড় বস্তুর মতো তাকে তুলে সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে মহাসড়কের মূল লেন থেকে সার্ভিস লেনে ছুঁড়ে ফেলা হয়। তখনও জীবিত ওই তরুণ।

সড়কের সার্ভিস লেনে থাকা পুলিশ সদস্যরা তখন ব্যস্ত মুহুর্মুহু গুলি ছোঁড়ায়। ওই সময় এক পুলিশ সদস্যকে বলতে শোনা যায়, ‘গুলি কর, গুলি কর, পিস্তল দিয়ে গুলি কর।’

ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ফেলে দেওয়ার পরপরই সেখানে একটি টিয়ারশেল পড়ে। আশপাশে থাকা পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে সরে যান। পড়ে থাকে শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের মরদেহ।

সূত্র বলছে, এপিসির ভেতরে মাঠ পর্যায়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছিলেন।

সেই ঘটনার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে কাঁদিয়েছে অনেককেই। ছেলের এমন মৃত্যু মানতে পারছে না পরিবারের সদস্যরা।

ইয়ামিনের বাবা মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘একজন জীবন্ত মানুষকে এভাবে কোনো মানুষ নিচে ফেলে দিতে পারে না। আমি কারও কাছে বিচার চাই না। জিডি করিনি। ছেলের লাশের পোস্টমর্টেম করাইনি। শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। সবাই দোয়া করবেন, আমরা যেন ধৈর্য ধরতে পারি।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা গত ১৮ জুলাই ঘটনার দিন জানিয়েছিলেন, ঘটনার দিন পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সম্মিলিতভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছুঁড়ছিলেন। ওই সময়ই দুপুর ২টার পরপর ওই এপিসিটি সড়কে আসে। সেটি থেকেও আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছোঁড়া হচ্ছিল। একপর্যায়ে ইয়ামিন সড়ক বিভাজক টপকে ওই এপিসির ওপরে উঠে যায়। সেখানেই সে গুলিবিদ্ধ হয়।

সড়কে পড়ে থাকার প্রায় ১ ঘণ্টা পর আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।

চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, ইয়ামিনের বুকের বা পাশ গলায় অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন ছিল।

গত ১৮ জুলাই এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মিজারুল রেহান পাভেল ও ডা. হাসান মাহবুব বলেছিলেন, ‘অসংখ্য রাবার বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে অধিক রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।’

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সাভারে প্রথম নিহত ছিলেন ইয়ামিন। মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা আগে ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে ইয়ামিন লিখেছিলেন, ‘শুধু কোটা নয়; গোটা দেশটাই সংস্কার প্রয়োজন।’

ছেলের মৃত্যুতে শোকাহত পুরো পরিবার। শোকে বিহ্বল তার সহপাঠীসহ সবাই। পরিবারের পক্ষ থেকে ইয়ামিনের নামে একটি ফাউন্ডেশন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই ফাউন্ডেশন থেকে ছাত্র আন্দোলনে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবার বা আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানা যায়।

সাভার/সনি

ঘটনাপ্রবাহ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়