ঢাকা     বুধবার   ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ||  মাঘ ১ ১৪৩১

বাবার মুখ দেখা হবে না অনাগত সন্তানের 

বেলাল রিজভী, মাদারীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৩৮, ২৪ আগস্ট ২০২৪   আপডেট: ১৭:৫২, ২৪ আগস্ট ২০২৪
বাবার মুখ দেখা হবে না অনাগত সন্তানের 

মনিরুজ্জামান মোল্লা

মনিরুজ্জামান মোল্লা (২৬)। মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের শাখারপাড় গ্রামের মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মোল্লার ছেলে। মনিরুজ্জামান ঢাকার সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে পড়ালেখা করতেন। পাশাপাশি একটি জুতার কোম্পানিতে কাজ করতেন। বছর দুয়েক আগে বিয়ে করেন। স্ত্রী ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বচ্ছলতা না থাকলেও সংসারে সুখ ছিল তাদের। 

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ডাকা মিছিলে যোগ দেন মনিরুজ্জামান। মিছিলে থাকা অবস্থায় জানতে পারেন, সরকারের পতন হয়েছে। তখন মনিরুজ্জামান তাঁর বন্ধু মো. আলম কাজীকে নিয়ে প্রবেশ করেন গণভবনে। উৎসুক জনতার সঙ্গে বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠেন তাঁরাও। তরে এ আনন্দ নিয়ে ঘরে ফেরা হয়নি তাঁর। ঘরে ফিরেছে লাশ হয়ে।

মনিরুজ্জামানের এমন মৃত্যু মানতে পারছে না তাঁর স্বজনরা। তাঁর স্ত্রী সামিরা ইসলাম ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীই ছিল তাঁর একমাত্র ভরসা। সামিরা বলেন, ‘আমার সন্তান এখনও পৃথিবীর আলো দেখেনি। তার আগেই ও বাবাকে হারাল। অনাগত সন্তান বাবার মুখ দেখবে না। এখন আমার সন্তান কাকে বাবা বলে ডাকবে? স্বামী ছাড়া এ দুনিয়াতে আমার আপন কেউ নেই। আমার স্বামীর কী দোষ ছিল? আমি কি আমার স্বামী হত্যাকারীদের বিচার পাব?’

আরো পড়ুন:

মনিরুজ্জামানের পরিবারের সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্ট সকালে মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয় মনিরুজ্জামান। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বন্ধু আলম। তাঁরাও অন্যদের দেখাদেখি গণভবনে যান। দুজনই লাল-সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে বিজয় উল্লাস করে সন্ধ্যার আগে গণভবন থেকে বের হয়ে আসেন। পরে তাঁরা পুলিশ সদর দপ্তর সংলগ্ন ফুলবাড়িয়া এলাকায় গিয়ে মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষ করার পর বের হয়ে দেখেন, তাঁদের মোটরসাইকেলটি দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে শুরু হয় গোলাগুলি। মনিরুজ্জামান ও আলম জীবন বাঁচাতে ছোটাছুটি শুরু করেন। এ সময় মনিরুজ্জামান গুলিবিদ্ধ হন ও আলম মারধরের শিকার হন। পরে গুরুতর অবস্থায় দুজনকে স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ওই দিন রাতে মনিরুজ্জামান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পর দিন ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় স্বজনেরা জানতে পারেন মনিরুজ্জামানের লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে রয়েছে। ওই দিন রাতে লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের শাখারপাড় মোল্লাবাড়িতে আনা হয়। পরদিন সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর দাফন করা হয়।

মনিরুজ্জামানের কথা জিজ্ঞাসা করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর মা মনোয়ারা বেগম। ছেলের কথা ভেবে এখনও বারবার মুর্ছা যান তিনি। বাবা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মোল্লাও বাকরুদ্ধ। কাঁদতে কাঁদতে মনোয়ারা বেগম বললেন, ‘আমার পোলাডারে গুলি কইরা মারছে, আমি কার কাছে এই কথা কমু? কার কাছে বিচার দিমু। আমার ছেলেডা ছোট হইলেও অনেক দায়িত্ব নিত। পোলাডা আমার মা-বাবা ছাড়াও বোনগো খেয়াল রাখত।’

তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট মনিরুজ্জামান। বড় দুই ভাই অন্য শহরে আলাদা থাকেন। ছোট ভাইয়ের মৃত্যু পর বড় দুই বোনও বাবার বাড়িতে এসেছেন। বোন নুসরাত জাহান বলেন, ‘আমার ভাইকে চারটি গুলি কইরা মারছে। বুকে, পিঠে, হাতে ও পায়ে চারটি গুলি করলে কেউ কি বাঁইচা থাকে।’

মনিরুজ্জামানের বন্ধু আলম কাজী বলেন, ‘আমরা গণভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ি। পতাকা হাতে নিয়ে ছবি তুলি। কত স্মৃতি আমাদের। ফেরার পথে ফুলবাড়িয়ায় যখন পুলিশের সঙ্গে লোকজনের সংঘর্ষ হচ্ছিল, আমরা তখন মাঝখানে পড়ে যাই। চারদিক থেকে তখন গুলির আওয়াজ। কিছু লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে আমাদের ওপর প্রথম হামলা চালায়। কিছুক্ষণ পরে দুজন দুদিকে সরে পড়ি। এরপর কিছু লোক আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে শুনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মনির (মনিরুজ্জামান) আর বেঁচে আর নেই। সেই দিনের কথা এখনও চোখে ভাসছে।’
 

/বকুল/

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়