ঢাকা     শনিবার   ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  ভাদ্র ৩০ ১৪৩১

এলাকায় লাপাত্তা জনপ্রতিনিধিরা, ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা

ফেনী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ৩০ আগস্ট ২০২৪  
এলাকায় লাপাত্তা জনপ্রতিনিধিরা, ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন ফেনীর অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি। এরই মধ্যে টানা তিন দফার বন্যায় বিপর্যস্ত জেলাটি। সর্বশেষ চলতি মাসের ২০ তারিখ থেকে ভারতের উজানের পানি ও ভারি বর্ষণে সৃষ্ট বন্যা ভয়াবহ রূপ নেয়। টানা তৃতীয় ধাপের বন্যায় এক সপ্তাহ ধরে জেলার ছয় উপজেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। 

জনপ্রতিনিধি শূন্য জেলায় ত্রাণ কার্যক্রমের একমাত্র ভরসা ছিল জেলা প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনী। বন্যায় ফেনীর করুণ চিত্র দাগ কাটে সারাদেশের মানুষের মনে। সাহায্য ও উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে ছুটে আসে জেলার বাইরের বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা। বন্যাকালীন সময় টানা ছয়দিন বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় জেলা-উপজেলা প্রশাসন ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর ত্রাণ বিতরণে ব্যাপক সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। 

জানা যায়, চরম খাদ্য সংকট মোকাবেলায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহ করা হলেও সমন্বয়হীনতার কারণে দুর্গম বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যার সময় বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে বেসরকারি সংগঠনগুলোর সমন্বয় করা যায়নি। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে বেসরকারি সংগঠনগুলো উপজেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে ত্রাণ বিতরণ করছেন। 

জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় না করে অনেক সংগঠন ত্রাণ বিতরণ করার কারণে সঠিক বণ্টন হচ্ছে না বলে দাবি সচেতন মহলের। তবে জেলা প্রশাসন বলছে চাহিদা অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণের জন্য বেসরকারিভাবে আগ্রহী ব্যক্তিদের সুনির্দিষ্ট সংগঠনের মাধ্যমে জেলা প্রশাসনকে অবহিত করার কথা বলা হলেও জেলার বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন সংগঠন ও স্থানীয় ভাবে অনেকে নিজ উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করছেন। 

ফেনী জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, ২৮ আগস্ট (বুধবার) পর্যন্ত জেলায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ৮৮ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ৬০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আরও দেড় লক্ষাধিক প্যাকেট করা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া বন্যা পরবর্তী ৬ উপজেলার মানুষদের খাদ্য সংকট মোকাবেলায় বুধবার থেকে চাল বিতরণ শুরু করেছে উপজেলা প্রশাসন। 

পরশুরাম উপজেলার চারিগ্রাম এলাকার বাসিন্দা রাজু আহমেদ বলেন, বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি ডুবে গেলে গত বুধবার (২১ আগস্ট) থেকে পাশের এক প্রতিবেশীর ভবনের ছাদে আশ্রয় নিয়েছি। ৩ দিনে মাত্র একটি সংগঠন থেকে শুকনো খাবার পেয়েছি। সে খাবার খেয়েই কোনো রকম বেঁচে ছিলাম। 

একই গ্রামের ষাটোর্ধ শাহেনা বেগম বলেন, লোকজন বলাবলি করছে সরকারি-বেসরকারিভাবে অনেক ত্রাণ আসছে। আমরাতো সে ত্রাণ চোখেও দেখলাম না। শুক্রবার বিকেলে কয়েকজন ছেলে নৌকা করে এসে এক প্যাকেট শুকনো খাবার দিয়ে গেছিলো। এর দুইদিন পর আমাদের এলাকার কয়েকজন এসে একটা শাড়ি দিয়ে গেছে। 

ফুলগাজী উপজেলার জগতপুর এলাকার বাসিন্দা মফিজুল ইসলাম বলেন, এমন বন্যা আমার বাপ দাদাও দেখেনি। টানা ৪ দিন আমাদের পুরো গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে ছিল। পানির তোড়ে জগতপুর থেকে আমজাদ মন্দারহাট সড়কের ১৭ স্থানে ভেঙে গেছে। বন্যার্তদের উদ্ধারে অনেকে এলেও ত্রাণবাহী নৌকা বা গাড়ি কম এসেছে। তবে এখন এলাকার বিত্তশালীদের উদ্যোগে ত্রাণ সহায়তা আসছে। 

ছাগলনাইয়া উপজেলার উত্তর যশপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, কিছুদিন আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেলার অনেক জনপ্রতিনিধি গা ঢাকা দিয়েছেন। প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণ না পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এটিও একটি বড় কারণ। এরপরও সরকারি-বেসরকারিভাবে অনেকে চেষ্টা করেছেন। 

ফেনী সদর উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল কাদের বলেন, চোখের সামনে দিয়ে কত ত্রাণের গাড়ি যেতে দেখেছি। যাদের কাছেই হাত পেতেছি তারা বলেছে এগুলো (ত্রাণ) পরশুরাম-ফুলগাজী এলাকায় নেওয়া হচ্ছে। বন্যার্তদের জন্য এত ত্রাণ এসেছে অথচ শহরের মানুষরা অনেকে ত্রাণ পায়নি। জেলা প্রশাসন থেকে সমন্বয় করে ত্রাণ বিতরণ করা হত তাহলে এ বৈষম্য হতো না। 

পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা হাবিব শাপলা বলেন, এ উপজেলা সরকারি ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩ হাজার ৮০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) থেকে পৌরসভা ও ইউনিয়ন ভিত্তিক চাল বিতরণ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ২০০ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন অনুসারে পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। 

ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া ভুঁইয়া বলেন, উপজেলার সব মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে উপজেলা প্রশাসন থেকে ২৫০ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে বিতরণের জন্য সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে। এর আগে বন্যার সময় সরকারি বরাদ্দসহ প্রায় ১৫ হাজার শুকনো খাবার বিতরণ জরা হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে বিতরণের পরিমাণ আরও বেশি। 

ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম কমল বলেন, বন্যা পরবর্তী মানুষের খাদ্য সংকট মোকাবেলায় উপজেলায় ২২৫ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু কিছু এলাকায় বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। 

সোনাগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, উপকূলীয় কয়েকটি ইউনিয়ন ছাড়া প্রায় এলাকা থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে মানুষজন নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাচ্ছেন। বন্যা দুর্গতদের খাদ্য সংকট মোকাবেলায় ২০০ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিতরণ কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। 

ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অতি ভারি বৃষ্টি ও উজানের ঢলের কারণে ফেনী জেলায় ভরাবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে বন্যায় পরশুরাম, বুলগাজী ও আগলনাইয়া উপজেলার মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং পরবর্তীতে ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঞা উপজেলাও আক্রান্ত হয়। এতে জেলায় ১০ লাখ মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে দেড় লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে এবং বাকীরা উঁচু ভবনে আশ্রয় নেন। ইতোমধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় মানুষজন নিজের ঘরে ফিরছেন। সশস্ত্র বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। যারা ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করছেন তাদেরও জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে বিতরণের জন্য আহ্বান করা হচ্ছে।

সাহাব উদ্দিন/ইমন


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়