খুমেক হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়েছে, রোগীদের দুর্ভোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা || রাইজিংবিডি.কম
হাসপাতালে আসা রোগীরা ডাক্তার না পেয়ে ফিরে যান
খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের বহির্বিভাগের স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়েছে। হাসপাতালের ৪১ চিকিৎসককে অবাঞ্ছিত ও কালো তালিকা করায় বন্ধ রয়েছে বহির্বিভাগের অধিকাংশ সেবা। বুধবার (৪ আগস্ট) সকাল থেকে বহির্বিভাগের অধিকাংশ চিকিৎসক আসেননি। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আগত রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) খুলনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক ডা. আক্তারুজ্জামানকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। এ সময় ৪১ জন চিকিৎসককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দেন কার্ডিওলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোস্তফা কামাল। ফলে আজ বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) নিরাপত্তা ঝুঁকিতে হাসপাতালে আসেনি অনেক চিকিৎসক।
হাসপাতালে সরেজমিন দেখা যায়, বর্হিবিভাগের ২০২ নং রুমের প্রীতম চক্রবর্তী, ২০৯ নং রুমের ডা. হিমেল সাহা, ২০৭ নং রুমের ডা. অনিরুদ্ধ সরদার, ২০৫ নং রুমের ডা. শেখ তাসনুভা আলম, ২০৪ নং রুমের ডা. সুব্রত কুমার মন্ডল, ২০৩ নং রুমের আরএমও ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার, ২১১ নং রুমের ডা. দীপ কুমার দাশ, ২১২ নং রুমের আরএমও ডা. সুমন রায়, ১০৩ নং রুমের ডা. তড়িৎ কান্তি ঘোষ, ৩০৮ নং রুমের ডা. নিরুপম মন্ডল, ২০৪ নং রুমের ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন, ৪১১ নং রুমের ডা. রনি দেবনাথ তালুকদার, ৪১০ নং রুমের ডা. মিথুন কুমার পাল, ৪১২ নং রুমের ডা. জিল্লুর রহমান তরুণ, ১০৫ নং রুমের চিকিৎসক শিবেন্দু মিস্ত্রিসহ প্রায় ২০ জন চিকিৎসক অনুপস্থিত ছিলেন। নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় তারা হাসপাতালে আসেননি বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া আন্তঃবিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার কনসালট্যান্টসহ ২১ জন চিকিৎসক অনুপস্থিত ছিলেন। এতে পুরো হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা সেবা না পেয়ে ফেরত যাচ্ছে।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলা থেকে আসা আরেফিন বিল্লাহ বলেন, ‘সকাল ১০টার দিকে বাড়ি থেকে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। দুপুর গড়িয়ে গেলেও চিকিৎসক আসেননি। আমি শিক্ষকতা করি। আজ ছুটি থাকায় এসেছি। অথচ এসে চিকিৎসক দেখাতে পারিনি। শুধু আমি নই, অন্য রোগীরাও ফিরে যাচ্ছেন।’
হাসপাতালে আসা রোগী সাদিয়া আফরিন বলেন, ‘ডাক্তার দেখাতে এসেছি সেই সকালে, এখনও দেখাতে পারিনি। আগামীকালও ডাক্তার আসবে কি-না জানি না।’
বাগেরহাট থেকে চিকিৎসা নিতে আসা কুলসুম বেগম বলেন, ‘ব্রেস্ট টিউমার নিয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছি। কাউন্টারে টিকিট কেটে নির্ধারিত কক্ষে এসে দেখি ডাক্তার নেই। এখন ফেরত যেতে হবে। কবে এ অবস্থা ঠিক হবে জানি না।’
প্রায় একই অভিযোগ রুপসা থেকে আসা দেলোয়ার হোসেন ও তার ছেলে ফাহিমের।
এ সব বিষয়ে খুমেকের পরিচালক, উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) এবং আরএস কেউ কর্মস্থলে না থাকায় কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া তাদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি অভিযুক্ত ডাক্তার মোস্তফা কামালের সেলফোনে একাধিকবার রিং করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
ডাক্তারদের রুমের সামনে রোগীদের সিরিয়াল দেখভালের দায়িত্বরতরা বলেন, ‘সকালে আমরা এসেছি। এসে দেখি চিকিৎসকরা আসেননি। ফোন করলে তারা জানিয়েছেন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন, এ জন্য আসেননি। রোগীরা আসছেন, আবার ফিরে যাচ্ছেন।’
এ বিষয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. সুমন রায় মুঠোফোনে বলেন, ‘গতকাল ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে তাদের দাবির বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিল। এ সময় ডাক্তার মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে কিছু শিক্ষার্থী এসে আমাদের ঘিরে ধরে। পরে তারা উপপরিচালককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। আর আমাদের প্রায় ৫১ জন চিকিৎসককে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেন৷ ফলে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি। নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় আমরা আসিনি।’
মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন নগরীর ১৭নং ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক মো. ফারুক বলেন, ‘মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম মনা আমাকে পাঠিয়েছেন, হাসপাতালে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চিকিৎসকদের নিয়ে কোনো বিশৃঙ্খলা হচ্ছে কি-না দেখতে। সকালে আমরা এখানে এসেছি। এসে দেখি ডা. মোস্তফা কামাল নেই। বহির্বিভাগে অনেক রোগী এসে ফিরে যাচ্ছে। এটা কাম্য নয়। আমরা চাই হাসপাতালের সুষ্ঠু পরিবেশ।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দেলনের সহ-সমন্বয়ক সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি বলেন, ‘গত ১৬ বছর বৈষম্যের শিকার হয়েছেন, তারা নিগৃহের শিকার হোক আমরা চাই না। আমরা জানতে পেরেছি, অনেকে ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাচ্ছেন। একজনকে সরিয়ে দিয়ে আরেকজনকে বসানোর একটা ফাইদা লোটার চেষ্টা চলছে।’
তিনি বলেন, ‘এখানে বার বার একজন ডাক্তারের নাম উঠে আসছে। তিনি হলেন কার্ডিওলোজি বিভাগের ডা. মোস্তফা কামাল। উনাকে আমরা পাইনি। উনার ব্যাপারেও আমরা তদন্ত করে দেখছি। কাউকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া আমরা সমর্থন করি না। কাউকে সরাতে হলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তদন্ত সাপেক্ষে ধাপে ধাপে করতে হবে।’
খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মনজুরুল মুর্শিদ বলেন, ‘হাসপাতাল সরাসরি আমাদের অধীনে না। তারপরও আমি বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সব জানানো হয়েছে।’
নুরুজ্জামান/বকুল