ঢাকা     সোমবার   ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||  আশ্বিন ১ ১৪৩১

গাজীখালি নদী দূষণ করেও ‘তারাসিমা’র রেহাই! 

জাহিদুল হক চন্দন, মানিকগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আপডেট: ২২:৫৭, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
গাজীখালি নদী দূষণ করেও ‘তারাসিমা’র রেহাই! 

তারাসিমা এ্যাপারেলস লিমিটেড-এর মূল ফটক

তারাসিমা এ্যাপারেলস লিমিটেড দেশের অন্যতম পরিবেশ বান্ধব শিল্প কারখানা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে ইটিপি (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) ব্যবস্থাপনাসহ আধুনিক সুযোগ সুবিধা। এতো কিছুর পরেও কারখানাটি গাজীখালি নদীতে দূষিত পানি ফেলে পরিবেশ দূষণ করছে। 

পরিবেশ অধিদপ্তরের নমুনা পরীক্ষায়ও দূষণের প্রমাণ মিলেছে। প্রমাণ পেয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নোটিস দেওয়া হয়েছে। তারপর আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর। সেই সাথে অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানেরও দূষণরোধে নেই দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ।

গত বছরের ২৩মে তারাসিমা এ্যাপারেলসের গাজীখালি নদী দূষণ নিয়ে রাইজিংবিডিতে ‘শিল্পকারখানার দূষণের কবলে গাজীখালি নদী’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পরও পরিবেশ অধিদপ্তর এক প্রকার নিশ্চুপ ভূমিকাই পালন করে। তারাসিমার নদী দূষণের নথিপত্র জোগাড় করতে দীর্ঘ এক বছরে কয়েক ধাপে অনুসন্ধান করে রাইজিংবিডি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৩ সালে ২ ফেব্রয়ারি তারাসিমার বিরুদ্ধে গাজীখালি নদী দূষণের অভিযোগ ওঠে। মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর মার্চ মাসের ৩ তারিখে প্রতিষ্ঠানটির ইটিপির আউটলেট ও গাজীখালি নদীতে পরিশোধিত তরল বর্জ্যের নির্গতমুখ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। ওই দিনই সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা গবেষণাগারে পাঠানো হয়। ওই নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায় এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে। নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে দূষণের প্রমাণ মেলে। ইটিপির আউটলেট ও গাজীখালি নদীর নির্গমণমুখে বিওডি, সিওডি ও টিডিএস-এর মানমাত্রার মধ্যে সামঞ্জ্যসতা নেই বলে প্রমাণ হয়। 

মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর তারাসিমা এ্যাপারেলস লিমিটেডকে এ বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়। পরে মে মাসের ৩ তারিখে প্রতিষ্ঠানটি লিখিত জবাব দাখিল করে। লিখিত জবাব পেয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

২০২৩ সালের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের উন্নয়ন সভায় তারাসিমা এ্যাপারেলস লিমিটেডের দূষণ নিয়ে একাধিকবার অভিযোগ ওঠে। জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলে পরিবেশ অধিদপ্তর তারাসিমাকে অক্টাবরের ৩০ তারিখে নদী দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে নোটিস জারি করে।

২০২৪ সালের মার্চ মাসের ১২ তারিখে দূষণের দায়ে প্রতিষ্ঠানটিকে আবারও নোটিস দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই নোটিসে বলা হয়, তারাসিমার ইটিপি থেকে তরল বর্জ্য ও স্লাজ বর্জ্যে গাজীখালি নদী দূষণ হতে দেখা গেছে। কারখানাটির স্লাজ বর্জ্য দ্বারা নদীর পানি দূষণ করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। নদীর তীর থেকে স্লাজ বর্জ্য অপসারণ করে পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানানোর নির্দেশ ও লিখিত জবাব দিতে বলা হয়। পরে ২১ এপ্রিল তারাসিমা আবারও লিখিত জবাব দিয়ে মুক্তি পায়।

এলাকাবাসী জানায়, তারাসিমা কারখানাটি শুরুর পর থেকে গাজীখালি নদী মরতে শুরু করে। আগে এ পানিতে গোসল করা, বাড়ির কাজে ব্যবহার করা গেলেও এখন আর ব্যবহার করা যায় না। এ পানি ব্যবহার করলে নানা ধরনের অসুখ হয়। বর্ষাকালে পানি একটু পরিষ্কার থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে পানি কালো হয়ে যায়।

রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির নদী দূষণের প্রমাণ পেয়েও ব্যবস্থা না নেওয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের গাফলতি। কার্যত ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে এসব প্রতিষ্ঠান নদী দূষণের সুযোগ পায়। গত বছর নদী দূষণ হয়ে থাকলেও এখনো প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সুযোগ রয়েছে এবং নেওয়া উচিত।’

তারাসিমা এ্যাপারেলস লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক (কমপ্লায়েন্স) কামরুজ্জামান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটি সূচনা লগ্ন থেকে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ারোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের নমুনা সংগহ করার সময় ইটিপির পরিশোধিত পানি কারখানার সৌন্দর্য বর্ধনের কাজে লেকে পাঠানো হচ্ছিলো। ফলে নমুনা পরীক্ষার ফলাফল এমন হয়েছে। কারখানাটি গাজীখালি নদী দূষণের জন্য দায়ী নয়। দেশের সকল প্রচলিত আইন মেনে কারখানাটি পরিচালিত হচ্ছে।’

মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. ইউসুফ আলী বলেন, ‘গত বছর তারাসিমার বিরুদ্ধে নদী দূষণের প্রমাণ পাওয়ার পর নোটিস করা হয়েছে। এ বছর সবশেষ নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে কারখানাটিতে দূষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তাই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’ 

গত বছর দূষণের প্রমাণ পেয়ে শুধু নোটিস করা হলো, আর কোনো ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয়নি- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ দপ্তরের এর চেয়ে বেশি কিছু করার নেই।’

//সনি


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়